আত্মপরিচয় খুঁজে ফেরা
আত্মপরিচয় খুঁজে ফেরা
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ
বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থে জানতে হলে, আমাদের আত্মপরিচয় খুঁজে পেতে হলে বেরিয়ে আসতে হবে প্রচলিত ইতিহাস চর্চার গণ্ডি থেকে। প্রাচীনতম কাল থেকে এ মাটির মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারা, চারিত্র্যিক স্বভাব, আচার-আচরণ, ধর্ম বিশ্বাস-এসব কিছুর ভিতর থেকেই আবিষ্কার করতে হবে বাঙালিকে। এ আবিষ্কার পাল্টে দেবে দৃশ্যপট। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বাঙালি আজকের হতাশ জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে যদি সে দেখতে পায় তার উজ্জ্বল অতীত।
এক সময় ধারণা ছিল পলিমাটির দেশ এই বাংলার ভূমিরূপ খুব নবীন। সমুদ্র থেকে জেগে উঠেছে সেদিন। তাই এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের সংস্কৃতি যখন দানা বাঁধে তখন আমরা অস্তিত্বহীন। এতো বেশি পুরনো সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিয়ে বুঝি গর্ব করার সুযোগ আমাদের নেই। তাই আমাদের প্রচলিত ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ক গ্রন্থগুলো বোধগম্য কারণেই এ ব্যাপারে নীরব। কিন্তু ভূতত্ত্ববিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের আধুনিক গবেষণা নতুনভাবে আলোড়ন তুলেছে। বাংলার অনেক অঞ্চলেরই ভূমিরূপ এর প্রাচীনত্বকে নিশ্চিত করেছে। আর এসব অঞ্চলে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ পাথর যুগের শিকারি মানুষের পদচারণার প্রমাণ প্রত্যক্ষ করেছেন। খুঁজে পেয়েছেন নানা ধরনের পাথুরে অস্ত্র। নবোপলীয় যুগে পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতার ধারক বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ যখন কৃষির আবিষ্কার করে বিপ্লব এনেছিল তখনও পিছিয়ে ছিল না আমাদের পূর্বসূরিরা। এ মাটিতেও গড়ে উঠেছিল কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। এভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ত্রিশ হাজার বছরের প্রাচীন সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছিল বাংলা।
পলিমাটির দেশ বাংলাদেশ। যুগে যুগে সাহিত্যে, আলোচনায় বাঙালির কোমলহৃদয়কে পলিমাটির উপমায় উপস্থাপন করা হয়েছে। এভাবে স্নিগ্ধতা ও কোমলতার মধ্যদিয়ে বাঙালির এক ধরনের মানবিক রূপ ফুটে উঠলেও ঢাকা পড়েছে তার শৌর্য-বীর্যের অহঙ্কারী দাপুটে রূপ। দেশপ্রেম বাঙালিকে যে অকুতোভয় বীরে রূপান্তরিত করতে পারে মুক্তিযুদ্ধই যেন তার বলিষ্ঠ প্রমাণ। সমকালীন নানা সূত্র পরীক্ষা করে বাংলার ইতিহাস নতুনভাবে মূল্যায়ন করার সুযোগ এসেছে। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে ভারতবর্ষে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল অহঙ্কারী আর্য জাতি। আর্যরা মনে করতো তারা যেখানে আসেনি সে মাটি অপবিত্র। তাই আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি করতে হবে ভারতকে। তবেই তাদের বাসযোগ্য হবে এ ভূমি। আর্য মুনি ‘বিদেঘ’কে পাঠানো হলো। তাঁর মুখ থেকে নির্গত আগুনে পুড়ে খাঁটি হলো চারপাশ। আর এই ‘পবিত্র’ অঞ্চলে বসতি গড়ে তুললো আর্যরা। সামগ্র ভারত মাড়িয়ে এক সময় বাংলার সীমানায় এলেন সন্ন্যাসী বিদেঘ। কিন্তু থমকে দাঁড়াতে হলো তাঁকে। প্রবেশ করা হলো না বাংলায়। আগুনে পুড়লো না এ মাটি। তাই আবাস গড়া হলো না আর্যদের। আর আর্যদের লেখা বইগুলোতে নিন্দা করা হলো বাংলার। বলা হলো ওখানে সব বর্বর-মূর্খদের বাস। ওরা পক্ষীর ভাষায় কথা বলে। আর্যরা কি বাস করতে পারে ওদের সঙ্গে!
আসলে পররাজ্য গ্রাস করার জন্যই যাযাবর আর্যরা এসেছে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠাও করেছে। কিন্তু বাংলায় আর্যদের রুখে দিয়েছিল বাঙালির বীরত্ব। তাই পরাজিত আর্যরা নিন্দা গেয়েছে বাঙালির। শুধু আর্য কেন, গ্রিক বীর আলেকজান্ডারও বিশ্বের বড়ো বড়ো দেশ জয় করে এসেছিলেন ভারতে। তাঁর দিগ্বিজয়ী সৈন্যদের একাংশ বাংলার সীমানায় এসেছিল। সেদিনও রুখে দাঁড়িয়েছিল বাঙালি। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে রোমের মহাকবি ভার্জিল বাঙালি বীরদের গাঁথা রচনা করেছিলেন। এ যুগেই ভূগোলবিদ টলেমি ও প্লিনি এবং অজানা গ্রিক নাবিকের লেখা ‘পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থে বাঙালির সুদৃঢ় রাজ্য গঙারিডির পরিচয় জানা গেছে। শক্তি, সমৃদ্ধিতে প্রতিষ্ঠিত বাঙালির পরিচয় মেলে এসব গ্রন্থে। প্রাচীন যুগ অতিক্রম করে মধ্যযুগে এসে পরাক্রান্ত বাঙালিকে এতোটুকু হীনবল মনে হয়নি। বিখ্যাত মোগল সম্রাট আকবর সমগ্র ভারত হাতের মুঠোয় রাখতে পেরেছিলেন সহজেই। কিন্তু বাংলার বড়ো বড়ো জমিদাররা একযোগে আটকে দিয়েছিল মোগলদের যাত্রাপথ। বারোভূঁইয়া নামের এই জমিদারদের অনেকেই ছিলেন বাঙালি। দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে অবশেষে বাংলা দখল করতে হয়েছিল মোগলদের। এভাবেই যুগে যুগে বাঙালি তার বীরত্বের সম্মানে উজ্জ্বল হয়েছে।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাঙালি মনীষার যে কৃতিত্বপূর্ণ ঐতিহ্য রয়েছে, তার কতোটুকু খোঁজ আছে আমাদের চারপাশের সহজলভ্য সূত্রগুলোতে? বহির্বঙ্গীয় বৈয়াকরণ পাণিনির খোঁজ কমবেশি আমরা রাখি। কিন্তু আমাদের প্রচলিত ইতিহাস-ঐতিহ্যের গ্রন্থগুলো ভুলতে বসেছে চন্দ্রগোমিনের নাম। প্রাচীন বাংলার মাটিতেই বেড়ে উঠেছিলেন বাঙালি বৈয়াকরণ চন্দ্রগোমিন। পাণিনির সূত্রের টিকাভাষ্য তৈরি করেছেন তিনি। যুক্ত করেছেন নিজের তৈরি আরো নানা সূত্র। এককালে প্রসিদ্ধ ছিল চন্দ্রগোমিনের ‘চান্দ্র ব্যাকরণ’। একইভাবে আমরা হারাতে বসেছি বাঙালি দার্শনিক গৌড়পাদকে। ‘গৌড়পাদ কারিকা’ নামের তন্ত্রশাস্ত্র রচনা করে যিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। আয়ুর্বেদশাস্ত্রের লেখক রোমপাদ এবং বিখ্যাত চিকিৎসক চক্রপানি দত্তের নামইবা আমরা কতোটুকু মনে রেখেছি। খুব অস্পষ্টভাবে আমরা স্মরণ করি বৌদ্ধ পণ্ডিত দীপঙ্কর শ্রী জ্ঞান বা অতীশ দীপঙ্কর, শান্তি রক্ষিত প্রমুখের নাম। অথচ তাঁদের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বহির্বঙ্গেতো বটেই, বহির্ভারতেও। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের অনেক নিষ্ঠা আর যত্নে বাংলা সাহিত্যের ভ্রূণশিশু চর্যাপদের জন্ম হয়েছিল। অথচ এই চর্যা গীতিকার স্রষ্টাদের কথা আমরা তেমনভাবে মনে রাখি না।
প্রাচীন যুগ অতিক্রম করে মধ্যযুগের বাংলায় প্রবেশ করার পরও আমাদের জানার তেমন সুযোগ হয়নি সমাজ ও সভ্যতার ধারাক্রম। প্রচলিত ইতিহাস গ্রন্থগুলো বখতিয়ার খলজির নদীয়া বিজয়ের মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের উদ্বোধন ঘটিয়েছে। একই ধারায় সুলতানি যুগের শাসনপ্রবাহ হয়েছে অতিক্রান্ত। সুলতান, পাঠান আর মোগল সুবাদারদের কর্মভূমিকা আলোচনায়ই ব্যস্ত থেকেছে রাজনৈতিক ইতিহাসের আদলে লেখা গ্রন্থগুলো। উপেক্ষিত থেকেছে সাধারণ মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আর অর্থনৈতিক জীবনের নানা দিক।
কি কারণে একটি বিশেষ সময়ে যুগের পরিবর্তন হলো? বৌদ্ধ, হিন্দুর শাসনে বিকশিত এ দেশের সমাজ কাঠামোর কিভাবে রূপান্তর ঘটলো? সাত শতকে আরব বণিকদের আগমন আর এগার শতক থেকে সুফি সাধকদের অবস্থান কিভাবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের দৃশ্যপট পাল্টে ফেলেছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর তেমন গভীরভাবে অনুসন্ধান করা হয়নি। সমাজ জীবনের কোন অন্তঃক্ষরণ মুসলমান ধর্ম প্রচারকদের আনুকূল্য দিয়েছে তাকে খোঁজা হয়নি বস্তুনিষ্ঠ সূত্র দিয়ে। কিভাবে বহির্ভারতীয় স্বাধীন সুলতানগণ তাঁদের কর্মভূমিকার মধ্য দিয়ে এ মাটির সন্তান হয়ে গিয়েছিলেন সেদিকটি তেমনভাবে খতিয়ে দেখিনি আমরা। মধ্যযুগের কাল পর্বে বাংলার অবাঙালি সুলতানরা তেমন নিষ্ঠা ও দরদ দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তা সর্বজনের কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়নি। শিক্ষা ও সংস্কৃতির অনুকূল স্রোত কেমন করে মধ্যযুগের বাঙালিকে উজ্জ্বল করেছে তা বিচ্ছিন্ন এবং সীমাবদ্ধভাবেই আবিষ্কার করার চেষ্টা নেওয়া হয়েছে।
এ যুগে সনাতন বাংলার ধর্ম-সংস্কৃতিতে যে আলোড়ন চলছিল-তার কতোটুকু খবর আমরা রাখতে পেরেছি। অথচ এই ভাঙচুরের মধ্যদিয়ে নতুনভাবে রূপায়িত হচ্ছিল বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি। ব্রাহ্মণ নেতাদের বৈরী ও স্বার্থবাদী দৃষ্টিভঙ্গি স্বধর্মের সাধারণ মানুষের জীবনকে করে তুলেছিল ওষ্ঠাগত। তাই যতটা না ধর্মীয় আবেগ তার চেয়ে অনেক বেশি আশ্রয়ের সন্ধান পেয়েছিল নবাগত ইসলাম ধর্মের ভিতর। সুফি সাধকদের মিশনারি তৎপরতা এ কারণে অনেক বেশি সফল হয়েছে। এ দেশ মুসলিম প্রধান অঞ্চলে রূপান্তরিত হওয়ার প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল এই সমাজ বিক্ষোভের মধ্য দিয়েই। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের গড়া অচলায়তনে সাধারণ শূদ্র পেয়েছিল প্রেমহীন এক দমবন্ধকর পরিবেশ। ফলে সুফিদের প্রেমবাণী তাদের মর্মমূলৈ প্রবেশ করেছিল নতুন জীবনের আশ্বাস নিয়ে। মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা ধর্মান্তরকরণের স্রোতকে অনেক বেগবান করেছিল। ফলে এ ভূখণ্ডে হিন্দু ধর্মের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। এই প্রেক্ষাপটেই পনের ষোল শতকে এলো নতুন আলোড়ন। বিপন্ন হিন্দু ধর্মকে রক্ষার জন্য শ্রী চৈতন্য এগিয়ে এলেন তাঁর নব্য বৈষ্ণব আন্দোলন নিয়ে। চৈতন্য এবং তাঁর নব্য বৈষ্ণববাদ নিয়ে প্রচুর চর্চা হয়েছে। কিন্তু সমাজ ইতিহাসের দৃষ্টিতে একে তেমনভাবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়নি। ফলে বাংলার সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারাবাহিকতা তৈরিতে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। নব্য বৈষ্ণব আন্দোলনের উৎস খুঁজতে গিয়ে নানা মনগড়া তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। তাই মূল সত্যটি থেকে যাচ্ছে অনুদঘাটিত।
শিল্পকলার ক্ষেত্রে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সোনা ফলিয়েছে। প্রাচীনকালে বৌদ্ধ শাসন পর্ব এ দিক থেকে দেখিয়েছে সাফল্য। পাহাড়পুর, ময়নামতিসহ নানা জায়গায় গড়ে উঠেছে বিহার। এসব স্থাপত্য তৈরিতে অপূর্ব দক্ষতা দেখাতে পেরেছে বাঙালি। মধ্যযুগে এসে মুসলমান সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্যালিগ্রাফির চমৎকার বিকাশ হয়েছে। মসজিদ, মাদ্রাসাসহ ধর্মীয় ও সামরিক স্থাপনাসমূহ গড়ে উঠেছে। দক্ষ মুদ্রাব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে সুলতানি যুগেই। শিল্পকলার ক্ষেত্রে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় কিভাবে উজ্জ্বল সাফল্য এসেছিল আজকের যুগ-যন্ত্রণায় কাতর আমরা তা অনুভব করতে পারি না। অথচ এসব অনুসন্ধান করা জীবন্ত জাকির পরিচায়ক।
এইচআর/আরআইপি