‘নারীরা কি শুধু সংরক্ষিত আসনেই থাকবে’
সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। অতীতের তুলনায় নারীর ক্ষমতায়ন এগিয়ে গেলেও রাজনীতি ও ক্ষমতার মূল স্রোতে তারা পিছিয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন নারী নেত্রীরা।
নারী নেত্রীরা মনে করেন, জাতীয় সংসদে আসন সংরক্ষিত ও সংসদ সদস্য নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে হয়তো নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এ অংশগ্রহণ প্রকৃতপক্ষে নারীদের রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত করছে না।
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদে সরাসরি ২৩টি আসন থেকে নির্বাচিত হন নারীরা। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২০টি, জাতীয় পার্টির দুইটি ও জাসদের একটি রয়েছে।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদে ২৭টি আসনে নারী প্রার্থী ছিলেন ২৮ জন। জয় পান ২৩ আসনে। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ ১৯, জাতীয় পার্টি তিন ও জাসদ একটি পায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে নারী প্রার্থীর হার ছিল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। যা মোট এক হাজার ৫৬৬ জনের মধ্যে মাত্র ৫৭ জন, জয়লাভ করেন মাত্র ১৯ জন। যা জনসংখ্যার অর্ধেক জনগোষ্ঠী হিসেবে মাত্র ছয় শতাংশ আসনে নারীদের বিজয়।
এসডিসির গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী নারীর সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৯০০ জন। ২০১৪ সালের ৪৫৮টি উপজেলা নির্বাচনে তা কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৫০৭ জনে। এ হিসাবে ২০০৯ সালে প্রতি উপজেলায় ৭-৯ জন নারী প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১৪ সালে এ হার গড়ে দাঁড়ায় ৩-৪ জনে। একইভাবে ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে মাত্র এক দশমিক ৬৩ শতাংশ নারী মেয়র পদে জয়লাভ করেন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালের ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ১১০ জন। তবে জয়লাভ করেন ২৩ জন। ২০১১ সালে ইউপি নির্বাচনে ২২৬ জন প্রার্থী হয়ে জয়ী হন ২৩ জন। ২০১৪ সালে ৪৫৮ ইউপি নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা ছিল এক হাজার ৫৬০ জন। ২০১৬ সালে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদে মাত্র ২৯ জন চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হন।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে নারী নেতৃত্বের হিসেবে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৮ দশমিক ৫১ শতাংশ, সিপিবি ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, বিএনপি ১৩ দশমিক ০৫, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ ও জাতীয় পার্টি আট দশমিক ৪৮ শতাংশ কোটা পূরণ করেছে।
বাংলাদেশে নারীদের উন্নয়ন অগ্রগতি নিয়ে ২০১২ সালে ড. নিবেদিতা দাশ পুরকায়স্থ ও উপমা দাশগুপ্তের যৌথভাবে লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়। সূচিপত্র প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘নারী ও বাংলাদেশ’নামে ওই বইটিতে বলা হয়, গ্রামীণ পর্যায়ে ৮৪ শতাংশ এবং শহরে ৫৯ শতাংশ নারী অবৈতনিক গৃহপরিচারিকা হিসেবে কর্মরত। দেশে পুরুষের তুলনায় নারীরা সপ্তাহে গড়ে ২১ ঘণ্টা বেশি কাজ করে।
ওই বই থেকে জানা যায়, দেশে নারী শ্রমশক্তির সংখা দুই কোটি ৫০ লাখ। প্রায় ৭৯ শতাংশ নারী কাজ করে কৃষিখাতে (মৎস ও বনায়নসহ), ৯ দশমিক ৯ শতাংশ ম্যানুফ্যাকচারিং ও পরিবহন খাতে, দুই দশমিক দুই শতাংশ বিপণন কাজে ও শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ করনিক কাজে নিয়োজিত। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ও কর্মসংস্থানের হার ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে, যা ২০১৫ সালে এসে ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই ঋণ বিতরণের অনুপাত ২০১০ থেকে ২০১৫ সালে ৪ দশমিক ৪৫ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৬ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে নারীদের এসএমই ঋণের অনুপাত ৪ শতাংশের বেশি হয়নি। ফলে ২০১৫ সালে নারী উদ্যোক্তাদের গড় ঋণের পরিমাণ পুরুষ উদ্যোক্তাদের ঋণের পরিমাণের মাত্র এক-দশমাংশ।
মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, নারীরা ক্ষমতায়িত হচ্ছে না এবং রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আসতে পারছে না। নারীরা কি শুধু সংরক্ষিত আসনেই থাকবে? না দলের নেতৃত্বে থেকে মূল রাজনীতিতে অংশ নেবে এ বিষয়টি এখন রাজনীতির এজেন্ডায় আসা উচিৎ।
নিজেরা করি সম্পাদক খুশি কবীর বলেন, ‘আমি মনে করি সরাসরি আসনগুলো থেকে ৫০ ভাগ নারীদের মনোনয়ন দেয়া উচিত। যদি তা না হয় তাহলে ওই ৩৩ শতাংশ অন্তত দেয়া উচিত। তাহলে আলাদাভাবে সংরক্ষিত আসনের দরকার হতো না। সংরক্ষিত আসন যদি রাখতেই হয় অবশ্যই নির্বাচন হতে হবে।’
আইনজীবী সালমা আলী বলেন, সংরক্ষিত আসনগুলোতে সংসদ সদস্য হিসেবে যারা মনোনীত হন তারা অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের চেয়ে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যদের মর্যাদা তুলনামূলক কম হয়। এ ক্ষেত্রে সরাসরি ভোটে নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হতে পারে।
এইউএ/এএইচ/এমএস