হাজিদের দুর্ভোগ : অভিযুক্ত এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল-জরিমানা

মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল
মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০১:৫১ পিএম, ০৬ মার্চ ২০১৯

রাজধানীর পুরান পল্টনের কেরানীগঞ্জ হজ ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরসের (লাইসেন্স নম্বর ৩৬৭) মাধ্যমে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ২০১৮ সালে হজে গিয়েছিলেন এবিএম মিজানুর রহমান নামে একজন হজযাত্রী। মক্কায় তাকেসহ একই এজেন্সির মাধ্যমে যাওয়া অন্য যাত্রীদের তিন চার কিলোমিটার দূরে ‘দুর ই খোদা’নামে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে রাখে এজেন্সিটি।

১০ দিন পর দাখিলা রোডে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে আসে যেখানে গত ২৮ আগস্ট রাতে সাপ দেখা যায়। ভয়ে সবাই সারারাত রাস্তায় কাটায়। পরদিন মেইনরোডে একটি বাড়িতে কোনোভাবে কাটে তাদের। শুরু থেকেই নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করে। এমন অভিযোগ এনে মক্কার কাউন্সিলর বরাবর অভিযোগ করেন মিজানুর রহমান। তদন্ত শেষে অভিযোগের সত্যতা পায় তদন্ত কমিটি। এ কারণে তিন বছরের জন্য এজেন্সিটির লাইসেন্স বাতিল করে ধর্ম মন্ত্রণালয়।

গতবছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে পবিত্র হজ পালনের সময় বিভিন্ন এজেন্সি প্রতিশ্রুতি দিয়েও হজযাত্রীদের নির্দিষ্ট মানের ও দূরত্বের বাড়িতে না রাখা, মিনা আরাফায় যানবাহনের ব্যবস্থা না করা এবং পচা বাসি খাবার সরবরাহসহ নানা প্রতারণার অভিযোগে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই কমপক্ষে পাঁচটি এজেন্সির হজ লাইন্সেস বাতিল, স্থগিত, জামানত বাজেয়াপ্ত, কারণ দর্শানো ও তিরস্কারের শাস্তি প্রদান করা হয়েছে।

মৌরি এয়ার ও আবাবিল ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরের লাইসেন্স বাতিল ও জামানত বাজেয়াপ্ত

মৌরি এয়ার ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নং ২৭২) ও আবাবিল ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরের (৩৭৮) হজ লাইসেন্স বাতিল ও জামানত বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশনা জারি করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।

মৌরি এয়ার ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে মুশফিকুর রহমান বাবুল নামে এক হজযাত্রী মক্কার হজ কাউন্সিলরের কাছে অভিযোগ করেন। তার অভিযোগ, অবসবাসযোগ্য একটি বাসায় এক রুমে ১৮ জনকে রাখা হয়। দুই রুম মিলে এক বাথরুম। তিনতলায় পাঁচটি রুম থাকলেও খাবার পানি নেই। ২০ জনের জন্য একটি বাথরুম। খাবারের পরিমাণ খুবই কম। ফলে হাজিরা রোগী হয়ে যাচ্ছে। টাকা না দিলে খাবার দেবে না এবং মদিনায় দেবে না।

অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় গত ৩ মার্চ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব ছিব্বির আহমেদ ওছমানী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে লাইসেন্স বাতিল ও জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশনা জারি হয়।

একইভাবে আবাবিল ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর এজেন্সির বিরুদ্ধে ডা. হারুন উর রশীদ নামে একজন হজযাত্রী মক্কায় হজ কাউন্সিলরের কাছে অভিযোগ করেন, হজ করতে এসে রুমে থাকার কষ্ট করতে হচ্ছে। খেতে গেলে বলা হয় মোয়াল্লেমের কাছে যান। বাসে উঠতে গেলে আপনার জন্য সিট নেই বলে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়া হয়। প্রথমে ৩ লাখ টাকা বলে পরে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকায় ৪৫ দিনের প্যাকেজের কথা বলে ৩৮ দিন রাখা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত ৩ মার্চ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব ছিব্বির আহমেদ ওছমানী স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে লাইসেন্স বাতিল ও জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশনা জারি হয়।

একই ধরনের অপরাধে সালওয়া ওভারসিজ লিমিটেড (লাইসেন্স নং ২৬৭), সামিট এয়ার ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নং ৫৫৮) ও ব্লু স্কাই এয়ারওয়েজের (লাইসেন্স নং ৭০৪) লাইসেন্স বাতিল ও জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়।

পটুয়াখালী ট্রাভেল এয়ার সার্ভিসেসের লাইসেন্স সাময়িক বাতিল ও জরিমানা

পটুয়াখালী ট্রাভেল এয়ার সার্ভিসেসের লাইসেন্স (নম্বর ১০৯৯) সাময়িকভাবে দুই বছরের জন্য বাতিল ও দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। আমিনা বেগম নামে একজন হজযাত্রী অভিযোগ করেন, তার স্বামী ইনসান আলী হজে গিয়ে গত বছরের ১৫ আগস্ট প্যারালাইসিসজনিত রোগে আক্রান্ত হলে তাকে কিং আবদুল আজিজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু কোনো উন্নতি না হওয়ায় দেশে ফেরত পাঠানোর প্রয়োজন হয়। কিন্তু এয়ার অ্যাম্বুলেন্সযোগে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে এজেন্সির পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতাই করা হয়নি। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

আফতাব ট্রাভেলের লাইসেন্স বাতিল ও জামানত বাজেয়াপ্ত

রাজধানীর পুরানা পল্টনের আফতাব ট্রাভেল ইন্টারন্যাশনালের লাইসেন্স (নং ০৫৮৪) বাতিল ও জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, জাল এফডিআরের কাগজ তৈরি করে প্রতারণার মাধ্যমে ব্যাংক থেকে জামানতের ২০ লাখ টাকা তুলে নেয়ার অপচেষ্টার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় লাইসেন্স বাতিল ও জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়।

রহমানিয়া এয়ার ট্রাভেলসকে তিরস্কার ও সতর্ক

যশোরের রহমানিয়া এয়ার ট্রাভেলসকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে তিরস্কার ও ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। এ এজেন্সির বিরুদ্ধে আমির হোসেন জুয়েল নামে একজন হজযাত্রী অভিযোগ করেন, কাবা শরীফের আধা কিলোমিটারের মধ্যে রাখার কথা বললেও দুই কিলোমিটার দূরে রিয়েল বক্স পাহাড়ের ওপর একটি বাড়িতে রাখা হয়। মাত্র ৮ দিন গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। কাবায় একদিনও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারেননি। মিনায় ১৩৫ নং মোয়াল্লেমের পাহাড়ি তাবুতে রাখে। ৯ জিলহজ ৩টা পর্যন্ত গাড়ি দেননি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরাফাহ, মুজদালিফা, মিনা ও মক্কা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার হেঁটে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছেন। বৃদ্ধা মাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে পথ পাড়ি দেন। মদিনাতেও বিলম্বে নেয়ায় ৪০ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারেননি।

এ অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হয়। এ কারণে তিরস্কার ও সতর্ক করা হয়।

এগারসিন্ধুর ট্রাভেলসকে কারণ দর্শানোর নোটিশ

বগুড়ার জনৈক মো. শরাফত আলী ও তার ছেলে বাকি বিল্লাহ রাজধানীর রামপুরার বেসরকারি হজ এজেন্সি এগারসিন্ধুর ট্রাভেলস লিমিটেডের (লাইসেন্স নং ৭৫০) বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, ২০১৭ সালে এ এজেন্সির মাধ্যমে প্রাক নিবন্ধন ও পরবর্তীতে ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা জমা দিলেও তাকে জানানো হয়, প্রাক নিবন্ধন ছাড়া আর কিছুই করেননি ফলে তিনি যেতে পারেননি। ওই এজেন্সি টাকা ও পাসপোর্টও ফেরত দেয়নি।

এ কারণে ৫ মার্চ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব ছিব্বির আহমেদ ওছমানী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে আগামী ৭ দিনের মধ্যে কেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না সে ব্যাপারে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি ও এ সময়ের মধ্যে টাকা ও পাসপোর্ট ফেরত দিতে নির্দেশ দেয় ।

মেরাজ এয়ার ইন্টারন্যাশনালকে তিরস্কার ও সতর্ক

২০১৮ সালে হজ ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণকারী মেরাজ এয়ার ইন্টারন্যাশনালকে (লাইসেন্স নং ২৫৩) তিরস্কার ও সতর্ক করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। এ এজেন্সির যাত্রী নজরানা ইয়াসমিন (হীরা) মক্কায় অভিযোগ করেন, বাসস্থান ও খাবার ব্যবস্থা খুবই বাজে ছিল। খাওয়ার পানি সরবরাহ করা হয়নি। বাসস্থান এলাকা পরিচ্ছন্ন ছিল না। চারজন নারী হারিয়ে গেলেও তাদের উদ্ধার করা হয়নি। মক্কায় নারী ও পুরুষের আলাদা ব্যবস্থা না করে একই ফ্লোরে রাখা হয়, আরাফার ময়দান থেকে বাসে আনার ব্যবস্থা ছিল না, হাজিদের সঙ্গ দুর্ব্যবহার করা হয়। তদন্তে সব অভিযোগ প্রমাণিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে অভিযোগকারী অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন।

এ কারণে গত ৩ মার্চ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব ছিব্বির আহমেদ ওছমানী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তাদের তিরস্কার ও ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করা হয়।

উল্লেখ্য, সৌদি আরব ও বাংলাদেশে প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে একাধিক তদন্ত শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক এসব ব্যবস্থা নেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, নতুন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ হাজিদের দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী এজেন্সির কাউকে ছাড় না দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। আরও বেশ কয়েকটি এজেন্সিকে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।

এমইউ/এনডিএস/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।