মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে কেউ খেলছে, সাবধান করলো দূতাবাস
হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায় এক অদৃশ্য সংকটে আটকে আছে জনশক্তি রফতানি। জি-টু-জি প্লাস পদ্ধতি বন্ধ করার পর সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও পাঠানো যাচ্ছে না শ্রমিক।
এদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে চলছে অপপ্রচার! বিপাকে দু’দেশের সংশ্লিষ্টরা। গত কয়দিন ধরে সামাজিক মাধ্যম ও কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ অপপ্রচারে টাকা-পয়সা লেনদেন না করতে দু’দেশের সংশ্লিষ্টরা আহ্বান জানিয়েছেন।
অভিযোগে এসেছে, অবশেষে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য খুলে গেল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। প্লান্টেশন খাতে ১০ হাজার কর্মীর ‘চাহিদাপত্র’ পাঠিয়েছে দেশটি। আবার কখনও রব উঠে অবৈধদের জন্য মালয়েশিয়া সরকার বৈধতা দিচ্ছে, অমুক সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘মালয়েশিয়ার বাজার খোলার দিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আরও কয়েকটি শ্রমবাজার চালুর জন্য কাজ চলছে এবং কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া বেশ এগিয়েছে।’
কেউ কেউ মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের মেডিকেল করিয়ে দিচ্ছে যাত্রার সম্ভাব্য তারিখও। মাঝে মাঝে এত কিছুর আয়োজন হয়ে গেলেও কিন্তু এসব বিষয়ে জানে না মালয়েশিয়া সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর ও মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস।
জানবেই বা কি করে! কারণ এসব তো কিছু দুষ্টু চক্র ও তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন কিছু নাম সর্বস্ব অনলাইন নিউজ পোর্টালের কারসাজী। প্রতারিত হচ্ছে যেমন কিছু লোক তেমনি বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে মালয়েশিয়া অবস্থানরত প্রবাসীরাও।
এসব দুষ্টু চক্রের মনগড়া সংবাদে বিভ্রান্ত না হতে প্রবাসীসহ সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম শাখা) মো. হেদায়েতুল ইসলাম মণ্ডল।
তিনি বলেন, ‘আকাশে চাঁদ উঠলে সকলে দেখবে এমন মন্তব্য করে এক ক্ষুদে বার্তায় হেদায়েতুল ইসলাম মণ্ডল জানান, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী আসবে এটা সত্য। কিন্তু মালয়েশিয়া সরকার তাদের কিছু প্রক্রিয়া সংশোধন করছে বলে তাতে কিছু সময় লাগছে এবং অবৈধদের ব্যাপারে যেন ভালো কিছু হয় সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ দূতাবাস কাজ করে যাচ্ছে।’
প্রথম সচিব বলেন, ‘বিভিন্ন মিডিয়ায় (সামাজিক ও অসাংবাদিক) মালয়েশিয়ায় সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষমান বিষয় নিয়ে এদের অতিরঞ্জিত ও বাড়াবাড়ি প্রচারণার কারণে অতিষ্ঠ মালয়েশিয়া সরকার ও জনগণ। এ ধরনের প্রচারণার কারণে একদিকে যেমন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ক্ষতি করা হচ্ছে অন্যদিকে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রি-হায়ারিং বা বৈধ হবার নামেও এরা চালাচ্ছে অপপ্রচার।
একটি সূত্রে জানা গেছে, দেশটির অনেক প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের চাহিদাপত্র চেয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগে জমা করলেও মিলছে শুধুই আশ্বাস। ফলে মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে জনশক্তি প্রেরণ এক রকম থমকে গেছে। কবে খুলবে এই বন্ধ দুয়ার তা জানে না কেউ। কিন্তু থেমে নেই হয়রানি। অবৈধ উপায়ে পাঠানোর হাতছানি দিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে টাকা, পাসপোর্ট নিয়ে নিচ্ছে দালাল চক্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার বিষয়ে মালয়েশিয়ায় সর্বশেষ যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত বছর সেপ্টেম্বরে। এরপর দুই দেশের মধ্যে আর কোনো বৈঠক হয়নি। কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশন দেশটির কর্তৃপক্ষের কাছে বৈঠক আয়োজনে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
মন্ত্রণালয় থেকেও মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়ে বৈঠকের কথা জানানো হয়েছে। কিন্তু মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ বৈঠকের বিষয়ে ইতিবাচক কোনো সাড়া দেয়নি। ফলে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ঢাকার বৈঠকের পর কুয়ালালামপুরে বৈঠক হয়। কুয়ালালামপুরের বৈঠকটি ফলপ্রসূ মনে হয়েছিল। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের বিষয়টি আরও জটিল হচ্ছে। মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের কাছে বৈঠকের সময় চেয়ে চিঠি দিলেও তারা কোনো সাড়া দিচ্ছে না। ইতোমধ্যে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে। তবে হাইকমিশনের সংশ্লিষ্টরা আশাবাদি খুব শিগগিরই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হবে।
এদিকে মালয়েশিয়ায় অবৈধদের বৈধকরণ প্রক্রিয়া নিয়েও চলছে অপপ্রচার। মালয়েশিয়ার বিগত সরকার তার দেশে থাকা অবৈধ বিদেশিদের বৈধ হওয়ার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। সেই হিসাবে সরকার মাই-ইজি, ভুক্তি মেঘা ও ইমান এ তিনটি ভেন্ডরকে দায়িত্ব দিয়েছিল অবৈধ বিদেশি কর্মীদের নাম নিবন্ধন করতে।
সে সময় এ ভেন্ডর কোম্পানিগুলো কোনে কোম্পানিতে কতজন শ্রমিক প্রয়োজন সেটা যাচাই-বাছাই না করে ঢালাওভাবে নিবন্ধন শুরু করে।
এ তিনটি ভেন্ডরের মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানিতে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ বাংলাদেশি কর্মী নিবন্ধিত হয়েছিলেন। নিবন্ধিতদের মধ্যে প্রায় তিন লাখের অধিক শ্রমিক ভিসা পেয়েছেন। তারপরও অনেকেই বৈধ হতে পারেননি। কারণ কারো নাম জটিলতা, কারো বয়স জটিলতা। আবার কেউ কেউ স্থানীয় এজেন্ট ও দালালকে পাসপোর্ট ও রিংগিত দিয়ে প্রতারণার শিকার হওয়ার কারণে বৈধ হতে পারেননি বলে শতশত অভিযোগ হাইকমিশনে জমা পড়ে।
মালয়েশিয়া গত বছরে মোট ১২ হাজারেরও বেশি অভিযানে ১ লাখ ৫৮ হাজার অভিবাসীর নথিপত্র যাচাইয়ের মাধ্যমে তাদের আটক করা হয়েছে। আটকদের মধ্যে কতজন বাংলাদেশি রয়েছে তা জানা যায়নি। দেশটিতে অবৈধ থাকা বিদেশি কর্মীদের বৈধ হওয়ার বিষয়টি দীর্ঘ আড়াই বছর ছিল আলোচনায়।
অবৈধ কর্মীদের কাজ দেয়ায় এবং বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে ১ হাজার ৩২৩ জন নিয়োগকর্তাকে আটক করা হয়। অভিবাসন বিভাগের কর্তারা বলছেন, অবৈধ অনুপ্রবেশ ও দেশটিতে অবৈধদের বসবাস ঠেকাতে বিভাগটি কাজ করছে এবং দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার তাগিদে কোনও পক্ষের সঙ্গে আপস করা হবে না বলেও জানান দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি বছরে ৭২ হাজার ৩’শ ৬১ জনকে পাসপোর্ট ও ভিসা জটিলতার কারণে অভিবাসন আইন ১৯৫৯/৬৩ এর ৮ (৩) ধারায় পাঁচ বছরের জন্য মালয়েশিয়া প্রবেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার মুহা. শহীদুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানান, মালয়েশিয়ার স্থগিত শ্রমবাজার খোলার ব্যাপারে সবকিছু চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। পরবর্তী ধাপ যেটা আছে সেটা হচ্ছে এ দেশের কেবিনেটে উঠবে। এরপর আমাদের কেবিনেটে এটি অ্যাপ্রোভ করাতে হবে।
প্রশ্নের উত্তরে হাই কমিশনার বলেন, ‘এত কিছুর পরও এখনো যারা আকাশপথে অথবা অবৈধভাবে থাকার জন্য মালয়েশিয়ায় আসার চিন্তা করছে, তারা যেনো ভুলেও এভাবে না আসে। এখন অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় আসা মানেই বিপজ্জনক। আর অবৈধভাবে এলে মালয়েশিয়া সরকার কোনোভাবেই তাদের কাজ করার সুযোগ দেবে না। বরং দেশের মান কমবে।’
তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশিরা তাদের সম্মানের জায়গা করে নিয়েছে। সে সম্মানের জায়গাটুকু ধরে রাখতে হলে যে দেশে কর্মরত রয়েছেন সে দেশের আইনকে সম্মান দেখাতে হবে এবং সকল ধরনের অপপ্রচার থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান হাইকমিশনার মুহা. শহীদুল ইসলাম।’
এমআরএম/এমএস