সর্ববৃহৎ প্রশ্নফাঁস চক্রের মূলোৎপাটন
![সর্ববৃহৎ প্রশ্নফাঁস চক্রের মূলোৎপাটন](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2019January/cid-1-20190131174602.jpg)
>> দেড় বছরে মাস্টারমাইন্ডসহ গ্রেফতার ৪৬
>> প্রশ্ন ফাঁস হতো দুইভাবে
>> দুই চক্র ভাঙার দাবি সিআইডির
প্রশ্নফাঁস ও পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনায় ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলে অভিযান চালিয়ে রানা ও মামুন নামের দুই শিক্ষার্থী এবং পরীক্ষার হল থেকে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী রাফিকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরদিন শাহবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়। পরবর্তিতে ওই তিনজনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রেসের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা এবং ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার একটি সিন্ডিকেটের তথ্য পায় সিআইডি।
এরপর গত দেড় বছরে প্রশ্ন ফাঁস ও পরীক্ষায় জালিয়ারিত সঙ্গে জড়িত থাকায় মোট ৪৬ জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি’র অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট।
সিআইডি’র অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা এবং ব্যাংকসহ সরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হওয়ায় সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে।
অর্গানাইজড ক্রাইম সিআইডি’র চৌকস টিম টানা প্রায় দেড় বছরে নিয়োগ ও ভর্তিতে প্রশ্নফাঁস এবং ডিজিটাল জালিয়াতির দুটি আলাদা চক্রকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনে।
সর্বশেষ গত কয়েকদিনে ডিজিটাল ডিভাইস জালিয়াত চক্রের অন্যতম হোতা হাফিজুর রহমান হাফিজ ও মাসুদ রহমান তাজুলকে গ্রেফতার করা হয়।
সিআইডি বলছে, প্রশ্নফাঁস ও পরীক্ষায় জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা আদালতে স্বীকারও করেছেন গ্রেফতাররা।
বৃহস্পতিবার সিআইডি’র সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রথম গ্রেফতারদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সাত শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে সিআইডি। এই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জানা যায়, পরীক্ষার আগেই প্রেস থেকে ফাঁস হয়ে যেত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন। আমরা প্রথমে জানতে পারি দুটি চক্র প্রশ্নফাঁস করে। একটি প্রেস থেকে। আরেকটি ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে।
প্রথমে প্রেস থেকে প্রশ্ন ফাঁসচক্রের মাস্টারমাইন্ড নাটোর জেলার ক্রীড়া কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান এছামী, প্রেস কর্মচারী খান বাহাদুর, তার আত্মীয় সাইফুল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বনি ও মারুফসহ মোট ২৮ আসামিকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে চক্রের মূলোৎপাটন করা হয়।
সংঘবদ্ধ এই চক্রটি ২০১৫ ও ২০১৬ সালে প্রেস থেকে প্রশ্ন ফাঁস করে এবং সাভারের একটি বাসায় আগের রাতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের পড়ায়।
দীর্ঘ তদন্তে দেখা যায়, ভর্তি কিংবা নিয়োগ পরীক্ষায় মূলত দুইভাবে জালিয়াতি হয়। একটি চক্র আগের রাতে প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। অন্য চক্রটি পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র নিয়ে দ্রুত তা সমাধান করে। এরপর ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীকে সরবরাহ করে।
তিনি বলেন, আগের রাতে প্রেস থেকে প্রশ্ন ফাঁসকারী পুরোচক্র চিহ্নিত করা গেলেও ডিভাইস চক্রটি বাকি ছিল। টানা কয়েকটি সাঁড়াশি অভিযানে নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াত চক্রটির মাস্টারমাইন্ড বিকেএসপির সহকারী পরিচালক অলিপ কুমার বিশ্বাস, মূল হোতা ৩৬তম বিসিএসে নন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত ইব্রাহীম মোল্যা, বিএডিসি’র সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল, আইয়ুব আলী বাঁধনসহ মোট নয় সদস্যকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম। চক্রটি গত কয়েক বছর ধরে লাখো তরুণের স্বপ্নের চাকরি বিসিএস পরীক্ষাতেও জালিয়াতি করেছে বলে জানা যায়।
এ ছাড়া পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে প্রশ্নপত্র সরবরাহের অভিযোগে রাজধানীর অগ্রণী স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক গোলাম মোহম্মদ বাবুল, অফিস সহায়ক (পিওন) আনোয়ার হোসেন মজুমদার ও মো. নুরুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। একই অভিযোগে ধানমন্ডি গভ. বয়েজ স্কুলের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হোসনে আরা বেগম ও পিওন হাসমত আলী শিকদারকেও গ্রেফতার করে সিআইডি। গ্রেফতারের সময় হাসমতের কাছে ওই দিনের বিসিএস লিখিত পরীক্ষার কয়েক কপি প্রশ্নপত্র ও ৬০ হাজার টাকা পাওয়া যায়।
চক্রটির ৬ জন মূল হোতার মধ্যে ৪ জনকে গ্রেফতার করা গেলেও জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হাফিজুর রহমান হাফিজ ও ব্যবসায়ী মাসুদ রহমান তাজুল ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। সর্বশেষ গত কয়েকদিনের অভিযানে এই দুজনকেও গ্রেফতার করা হয়।
অলিপ, ইব্রাহীম, মোস্তফা, তাজুল, হাফিজ ও বাঁধন- ডিভাইজ জালিয়াতির এই ৬ মূল হোতার প্রত্যেকের আবার নিজস্ব সহযোগী চক্র ছিল। সর্বশেষ অভিযানে এদের সহযোগিদের কয়েক জনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
অলিপের অন্যতম সহযোগী অগ্রণী ব্যাংকের ক্যাশ অফিসার জাহাঙ্গীর আলম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী সাঈদুর রহমান সাঈদ, তাজুলের প্রধান সহযোগী ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী অসীম বিশ্বাস, বেসরকারি গ্রিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রিমন হোসেন, ঢাকা কলেজের পিওন মোশারফ হোসেন মুসা ও হাফিজুর রহমান হাফিজের ভাই আব্দুর রহমান রমিজকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে অসীম বিশ্বাস মুম্বাই থেকে পরীক্ষায় জালিয়াতিতে ব্যবহৃত কয়েক শত ইলেকট্রনিকস ডিভাইস আমদানি করেছেন।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত আইজিপি ও সিআইডি’র প্রধান শেখ হিমায়েত উদ্দিন বলেন, সরকার প্রশ্ন ফাঁস ও পরীক্ষায় জালিয়াতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সিআইডি কাজ করেছে। এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ প্রশ্নফাঁস চক্রটির মূলোৎপাটিত হয়েছে। জালিয়াত চক্রটির ৪৬জনকে গ্রেফতারের মাধ্যমে অন্য প্রশ্নফাঁস ও পরীক্ষায় জালিয়াতকারীদের ও পরোক্ষা সহযোগীদের একটা শক্ত ম্যাসেজ দেয়া গেছে।
জেইউ/জেডএ/এমকেএইচ