স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির ১১ উৎস : প্রতিরোধে ২৫ সুপারিশ
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাতিষ্ঠানিক টিম স্বাস্থ্য খাতে ১১ দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করেছে। একই সঙ্গে এসব প্রতিরোধে ২৫ দফা সুপারিশও করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বৃহস্পতিবার (৩১ জানুয়ারি) সচিবালয়ে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের হাতে তুলে দেন দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান।
কমিশনার বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করে যেসব জায়গায় দুর্নীতি ঘটে বলে তথ্য রয়েছে সেসব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করেছি।’
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরির কাজ শুরু হয় ২০০৮ থেকে। ২০১৭ সালে ২৫টি টিম গঠন করেছি বিভিন্ন বিভাগকে মূল্যায়নের জন্য। এটি এরই একটি অংশ। আমরা ইতোপূর্বে এনবিআর, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য কতিপয় মন্ত্রণালয়ের ৭/৮টি রিপোর্ট হস্তান্তর করেছি। আমরা বিশ্বাস করি কর্তৃপক্ষ রিপোর্টগুলো সাদরে গ্রহণ করেছেন। সেখানে যে পরামর্শ দেয়া হয়েছে সেগুলোর ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন ও প্রতিকারমূলক কার্যক্রম তারা গ্রহণ করবেন। ফলে এটি দুর্নীতি দমনে অনেক সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।’
মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘আজকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে সেই রকমই একটি প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছি। এ রিপোর্টের মধ্যে আমাদের টিম শনাক্ত করেছে কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে সে বিষয়গুলো। সে সম্ভাবনাগুলো কীভাবে দূর করা যায় সেই বিষয়ে কতিপয় সুপারিশ। এখানে ১১টি জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে আমরা মনে করেছি যেখানে দুর্নীতির ক্ষেত্র রয়েছে। সেগুলো স্বাভাবিক রাখার জন্য ২৫টি সুপারিশ করা হয়েছে। সেই পরামর্শগুলো যদি মন্ত্রণালয় থেকে গ্রহণ করা হয় তবে নিঃসন্দেহে দুর্নীতি প্রতিরোধমূলক কাজে ভালো ফল দেবে।’
তিনি বলেন, ‘যদি দুর্নীতি মোকোবেলা করতে না পারি তবে আমাদের এই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
স্বাস্থ্য খাতে ক্রয়, সেবা, নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, ইকুইপমেন্ট ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহসহ ১১টি দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে বলে দুদকের এক কর্মকর্তা জানান।
মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ প্রতিবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে। আমাদের প্রতিটি অনুসন্ধানী মতামত তাদের কাছে সাদরে গৃহীত হবে। সেই অনুযায়ী কাজ করলে আগামী দিনে বলতে পারবো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অধিকতর ভালো অস্থানে আছে।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিবেদনে কী আছে তা স্টাডি করে দেখব। এটুকু বলতে পারি আগামী দিনগুলোতে স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নত হবে। এলিগেশন যেগুলো আছে, দুর্নাম যেগুলো আছে ইনশাআলআল্লাহ আগামীতে ঘুচাব।’
প্রতিবেদনের সুপারিশের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে দুদক কমিশনার বলেন, ‘আমরা বাইরে থেকে দেখি অনেক মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন নীতিমালা থাকে না। অনেক মন্ত্রণালয়ের মতো এখানেও পদায়ন নীতিমালা নেই। পদায়নের ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি যাতে দীর্ঘকাল অবস্থান করতে না পারে। এভাবে থাকলে একটি সংঘবদ্ধ দল তৈরি হয়ে যায়। এটা যাতে না করা হয়। সঠিক স্থানে সঠিক ব্যক্তিকে যাতে পদায়ন করা হয়, সেই সুপারিশ করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে (চিকিৎসক) গ্রামে যেতে চান না। পদোন্নতির ক্ষেত্রে গ্রামের কাজ করার শর্ত আরোপ করার কথা আমরা বলেছি। গ্রামে কাজ না করলে ভবিষ্যতে তা যেন পদোন্নতির ক্ষেত্রে অন্তরায় হয় সেই পরামর্শ আমরা দিয়েছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মনে হয় এসবের সঙ্গে দ্বিমত করে না, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কিছু ঘাটতি রয়েছে।’
‘সেবাটা যাতে টাইম বাউন্ড হয় আমরা সেই বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছি। সময় বেঁধে দিলে গৃহীতা জানতে পারবে কোন কাজের জন্য তার কতদিন অপেক্ষা করতে হবে’ বলেন মোজাম্মেল হক খান।
তিনি আরও বলেন, ‘ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যাপারে অনেক সময় কথা আসে। সরকারি হাসপাতালে ওষুধ আছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো অনেক সময় করা যায় না, কিছু অনৈতিক কার্যকলাপ থাকে। সেগুলো যাতে না হয়, মানুষকে যেন অহেতুক খরচের মধ্যে ফেলা না হয় সেই বিষয়ে খবরদারি করার চেষ্টা করেছি। বলেছি সার্ভিলেন্স টিম যাতে গঠন করা হয়।’
দুদক কমিশনার আরও বলেন, ‘অনেকে দালালের খপ্পরে পড়ে। গ্রাম থেকে আসা সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে অন্য হাসপাতালে নিয়ে দেখানো হয়। সেখানে কর্মচারীরা ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে কিছুটা লাভবানও হয়। এমন অনেক অভিযোগ আমাদের কাছে আসে। এক্ষেত্রে হাসপাতাল সিসিটিভির আওতায় আনা যেতে পারে। কারা এগুলো করছে তাদের যাতে ধরা যায়।’
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর গঠনের মাধ্যমে সেবার মান বাড়ানোর বিষয়েও প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে বলেও জানান কমিশনার।
তিনি বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসককের পদোন্নতি যাতে স্বচ্ছতার সঙ্গে দেয়া যায়, এটা নিয়ে যাতে মানুষের মনে কোনো প্রশ্ন তৈরি না হয়, সে ব্যাপারেও কিছু পরামর্শ দিয়েছি। সরকারি ডাক্তারদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটা অথরিটি হতে পারে। বেসরকারি মেডিকেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর মিলে সমন্বিতভাবে থেকে যাতে চিকিৎসকদের পদোন্নতি দেয়া যায়।’
‘কেনাকাটার ক্ষেত্রে কিছু অনিয়নের কথা শোনা যায়। যে মানের জিনিস কেনার কথা তা কেনা হয় না। এক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়েছি ক্রয় কমিটিতে যাতে পেশাদার লোক রাখা হয়। কেনার পর রিসিভ করার সময় যেন পেশাদার ও যোগ্য লোক দিয়ে তা করানো হয়। ক্রয়ের ক্ষেত্রে যে আইন রয়েছে সেটা ফলো করলেও কেনাকাটা নিয়ে মানুষের সন্দেহ দূর হবে এবং ভালেঅ জিনিস কেনা যাবে।’
প্রতিবেদনে দ্বিমত করার মতো কোনো শব্দ এখানে নেই জানিয়ে মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কথাবার্তাই এখানে রয়েছে। যেটুকু গ্রহণযোগ্যতা পাবে সেটুকু নিয়ে আপনারা (স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সচিব) তা প্রকাশ করতে পারেন। সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে আমরা সবাই মিলে লাভবান হব।’
দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, ২৫ দফা সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি হল- তথ্যবহুল সিটিজেন চার্টার করা, ওষুধ ও মেডিকেল ইকুইপমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে ইজিপি টেন্ডার অনুসরণ করা। ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপনের অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব স্থায়ী চিকিৎসক/কর্মচারী ও কার্যনির্বাহী কমিটি ইত্যাদি রয়েছে কিনা সেসব বিষয় নিশ্চিত হওয়া। বদলির নীতিমালা প্রণয়ন, চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের নাম না লিখে জেনেরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক করা, ইন্টার্নশিপ এক বছর থেকে বাড়িয়ে দু’বছর এবং বর্ধিত এক বছর উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতলে থাকা বাধ্যতামূলক করারও সুপারিশ করেছে কমিশন।
আরএমএম/এএইচ/আরআইপি