তুমুল লড়াইয়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে থাকে
২ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ থেকে সম্মুখযুদ্ধের গতি অনেক বেড়ে যায়। অপ্রতিরোধ্য বাঙালির বিজয়ের পথে পাকিস্তানি বাহিনীর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল লড়াইয়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে থাকে। নয় মাস অবরুদ্ধ দেশের অভ্যন্তরে অনেক মুক্তাঞ্চল তৈরি হয়। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী পঞ্চগড়ে রিংয়ের আকারে প্রথম ও দ্বিতীয় ডিফেন্স লাইন তৈরি করে। মুজিব বাহিনীর যোদ্ধারা মিত্রবাহিনীর সহায়তায় গভীর রাতে পঞ্চগড় আক্রমণ করায় তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
এদিন মুক্তির সংগ্রামে উত্তাল ছিল বাংলার মাটি, বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পাকবাহিনী পিছু হটছে। মুক্তিবাহিনী ঘোড়াশালে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর চারিদিক থেকে আক্রমণ করে ২৭ পাকহানাদারকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। এখান থেকে বেশকিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনী। এদিকে আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এলেও পাকবাহিনী তাদের বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠে মুক্তিবাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী পুনরায় তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তিনদিক থেকে শত্রুকে আক্রমণ করলে পাকবাহিনী আজমপুর রেলস্টেশন ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এদিকে চট্টগ্রাম মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা উত্তরে ফটিকছড়ি ও রাউজান থানা এবং দক্ষিণে আনোয়ারার অধিকাংশ স্থান দখলে আনতে সক্ষম হয়। পাক কমান্ডার মোসলেউদ্দিন ভালুকা থেকে একদল রাজাকার সঙ্গে নিয়ে কাঁঠালী গ্রামে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করতে গেলে মুক্তিবাহিনীর সেকশন কমান্ডার গিয়াসউদ্দিন এবং ৩ নম্বর সেকশন কমান্ডার আব্দুল ওয়াহেদের নেতৃত্বে পরিচালিত অতর্কিত আক্রমণে তিন পাকহানাদার এবং সাতজন রাজাকার নিহত হয় এবং সাত পাকসৈন্য আহত হয। পরে পাকহানাদাররা মৃতদেহগুলো নিয়ে পালিয়ে যায়। শত্রুপক্ষ বুঝতে পারে মুক্তিযোদ্ধাদের আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। পরাজয় নিশ্চিত জেনে মরণকামড় দিতে শুরু করে দখলদার বাহিনী।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজী তার রাজাকার আলবদর ও সেনাবাহিনীকে দেশের চারদিকে ছড়িয়ে দেয় হত্যাযজ্ঞ চালাতে। কিন্তু এ দিনে গেরিলা আক্রমণ থেকে সম্মুখযুদ্ধের গতি বাড়ে। অপ্রতিরোধ্য বাঙালির বিজয় রথে পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে থাকে। প্রবাসী সরকার অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়, বাংলাদেশের বিজয় আসন্ন। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর প্রচারিত হতে থাকে। রেডিওতে বাজে বিজয়ের গান। রাজধানী ঢাকায় গেরিলাযোদ্ধারা একের পর এক গুঁড়িয়ে দিচ্ছে দখলদারদের আস্তানা। সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা অাগেই শত্রুমুক্ত হয়েছিল লে. জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর দ্বারা।
ডিসেম্বরের শুরুতে বসন্তপুর, কালীগঞ্জ, নাছ্গিঞ্জ, পারুলিয়া প্রভৃতি এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের পিছু হটিয়ে মুক্তিবাহিনী সাতক্ষীরায় উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়। রূপসা নদীর ওপারে খুলনায় কাছে ঘাঁটি স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল। দেশের গভীরতম স্থানেও যে মুক্তিবাহিনী ক্রমে শক্তি সঞ্চার করে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল, তার পরিচয় নানা স্থান থেকে মিলছিল। নাগরপুর থানা মুক্ত হওয়ার ফলে টাঙ্গাইলে আক্রমণ পরিচালনা হয়ে পড়ে অত্যাসন্ন। সিলেটে শমসেরনগর বিমানবন্দরের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা দল। বিবিসি ভোয়া আকাশবাণী বা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদে উচ্চারিত বিভিন্ন স্থানের নাম কোটি মানুষের বুকে জায়গা তো অন্য এক অনুভূতি।
২ ডিসেম্বর সীমান্তসংঘাত তীব্র হয়ে ওঠে। পাকিস্তান অভিযোগ করেছিল যে সাতটি স্থানে ভারত যুদ্ধের ফ্রন্ট খুলেছে এবং তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহে আঘাত হেনেছে। ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই ত্রিমুখী যুদ্ধের আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। এসব দেখেশুনে ভারত সরকার বুঝেছিল, পাকিস্তান যুদ্ধ করবেই। ভারত তখন যে রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা বা আসা একেবারে ছেড়ে দিয়েছে, তা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে ভারত সামরিক প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। পশ্চিমের প্রস্তুতি দেখে এবং নাশকতামূলক কাজের লোক ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত মোটামুটি পরিষ্কার বুঝে ফেলে পাকিস্তান রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যাবে না। বরং লড়াই-ই করবে। তখন থেকে ভারতের প্রস্তুতিও জোরদার হয়েছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসের কর্মীসভায় বলেছিলেন, সময় বদলেছে, তিন-চার হাজার মাইল দূর থেকে তাদের (পাকিস্তান) ইচ্ছামতো হুকুম মেনে নেয়া যায় না। আজ আমরা সর্বোচ্চ প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করব। ওইসব বৃহৎ দেশের ইচ্ছা অনুযায়ী নয়। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার আহ্বান জানান।
এফএইচএস/বিএ/এমএস