মাকালকান্দি গণহত্যা দিবস আজ
অথৈ পানিবেষ্টিত হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চলের গ্রাম মাকালকান্দি। প্রত্যন্ত এ গ্রামের লোকেরা হয়তো হিটলারের নাম শুনেছেন। তার নাৎসি বাহিনীর নামও শুনে থাকতে পারেন। তবে এ নাৎসি বাহিনীর নির্যাতনের ভয়াবহতার কাহিনি সম্পর্কে গ্রামীণ এসব মানুষের একেবারেই অজানা। অথচ কে জানতো, একদিন এ গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষদের উপরই নেমে আসবে নাৎসি বাহিনীর চেয়েও আরো ভয়ানক নির্যাতন।
১৯৭১ সালের ১৮ আগস্ট। বর্ষাকাল। চারদিকে অথৈ পানি আর পানি। সকালে গ্রামের চণ্ডি মন্দিরে মনসা পূজার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামের বাসিন্দারা। এ সময় রাজাকারদের সহায়তায় একযোগে ৪০/৫০টি নৌকাভর্তি পাক হানাদার বাহিনী এসে হাজির হয়। মুহূর্তের মধ্যেই তারা চালায় তাণ্ডব। পুরো গ্রামজুড়ে শুরু হয় হুলস্থুল। এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোররা। সকলের মাঝেই আতঙ্ক আর বাঁচার আকুতি। কিন্তু পাক হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি কেউই।
পূজারত নারী-পুরুষকে চণ্ডি মন্দিরের সামনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে একই পরিবারের ১১ জনসহ দুই শতাধিক মানুষকে হত্যা করে হায়েনারা। নারী, পুরুষতো নয়-ই, তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি কোমলমতি শিশু, কিশোররাও। এতেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল নিরীহ গ্রামবাসীর বাড়িঘর। এ ঘটনার পর ভারতে পালিয়ে যায় অনেকেই। সে সময় ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন অসুখে আরো কমপক্ষে ২/৩শ’ জনের মৃত্যু হয়।
এদিকে পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় ভাটি বাংলার শিক্ষা-দীক্ষা, খাদ্য ভাণ্ডারে সমৃদ্ধশালী গ্রাম মাকালকান্দি থেকে লুটে নেয় কোটি টাকার সম্পদ। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা ওই ঘটনায় পাকবাহিনীর সহচর অনেক রাজাকারের নাম এখনো ভুলতে পারেননি। নির্দ্বিধায় বলেছেন জীবিতদের নাম। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হত্যাযজ্ঞে যোগ দিয়েছিলেন সৈয়দ ফজলে হক মোতাওয়াল্লী, বানিয়াচং উপজেলা বিএনপির সাবেক প্রচার সম্পাদক কনর মিয়া, আব্দুল খালিক, আজমান, ইব্রাহিম শেখ, আতাউরসহ অনেকে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত অবস্থায় দিন যাপন করছে এ গ্রামের অসংখ্য পরিবার। সেই কলঙ্কিত ঘটনার পর জনমানব শূন্য মাকালকান্দির শত শত হেক্টর জমি দখলে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তাদের চাপে আবার কেউ কেউ পানির দামে বিক্রি করে দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশে দেশান্তর হয়েছে।
বানিয়াচং উপজেলা সদর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ভাটি অঞ্চলে কাগাপাশা ইউনিয়নে হাওরে দ্বীপের মতো অবস্থান মাকালকান্দি গ্রামটির। শিক্ষা-দীক্ষা ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধশালী গ্রামটি হিন্দু অধ্যুষিত। যে পরিবেরর ১১ জনকে হত্যা করে পাক হায়েনারা সেই পরিবারের বর্তমানে একজন মাত্র সদস্য বেঁচে আছেন। তিনি গোপাল রঞ্জন চৌধুরী।
তিনি জানান, নিহতদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। এ সময় মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তিন মাসের শিশু পুত্র কানুকে গুলি করে হত্যা করে হাওরের পানিতে ফেলে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে ওই শিশুর মা মিনতি রানী চৌধুরী জানান, সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আমি বেঁচে গেছি। কিন্তু আমার কোল থেকে ছেলেটি নিয়ে তারা হত্যা করে। হায়েনাদের গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে রক্তাক্ত কানুকে কোলে নেয়ার পর তারা আবারো তাকে কেড়ে নিয়ে পানিতে ফেলে দেয়। তারপর তারা আমাকে গলায় শাড়ি ঝুলিয়ে পুরো গ্রাম প্রদক্ষিণ করে।
মিনতি রানী বলেন, আমি পাকিস্তানি ও রাজাকারদের বলি আমার ছেলেকে তোমরা মেরে ফেলেছে, এখন আমাকেও মেরে ফেলো। আমাকে তারা পঙ্গু করে দেয়। এতে আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ও ভারতে উন্নত চিকিৎসার পর আমি সুস্থ হই। তবে পঙ্গুত্ব নিয়ে চলতে হচ্ছে।
গণহত্যার বিষয়ে মাকালকান্দি গ্রামের বাসিন্দা সুনামগঞ্জ জগদল আল ফারুক হাইস্কুলের তৎকালীন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র প্রাণ গোপাল দাশ জানান, পাকবাহিনী ধ্বংষযজ্ঞ শেষে তাকে জোরপূর্বক নৌকায় করে ধরে নিয়ে যায়। তারা রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ ফজলে হক মোতাওয়াল্লীর হাতে তুলে দেয়। তিনি বলেন, ১৪/১৫ দিন পর তার আত্মীয়-স্বজনরা রাজাকার কমান্ডারের বাড়ি থেকে আমাকে নিয়ে আসেন।
করুণা সিন্ধু চৌধুরী জানান, ঘটনার পর তারা ভারতে চলে যান। সেখানে যাওয়ার সময় এবং ভারতের ক্যাম্পে ডায়রিয়া, অর্ধাহারে-অনাহারে আরো তিন শতাধিক লোক মারা যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা এসে দেখতে পান চণ্ডি মন্দির ও এর আশপাশে অসংখ্য কঙ্কাল। এগুলো সৎকার করা হয়নি। পরে তারা গ্রামের পাশে একটি জায়গায় গণকবর দেন।
এ ব্যাপারে বানিয়াচং উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল খালেক জানান, রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে তা ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। তারপর রাজাকাররা গ্রামটি জ্বালিয়ে দিয়ে যে পরিমাণ ধনসম্পদ লুট করেছে তার বর্ণনা দেয়াও সম্ভব নয়। তিনি সরকারের কাছে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সাহায্য কামনা করেছেন।
স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর ২০০৮ সালে এ গ্রামে গণহত্যা দিবসে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরে আলম সিদ্দিকীর উদ্যোগে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এতে নিহত ৮৫ জনের নাম লেখা রয়েছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মাকালকান্দিতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তবে তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পার হলেও সেসব শহীদদের স্মরণে সরকারিভাবে গড়ে ওঠেনি কোনো স্মৃতিসৌধ। তাছাড়া শহীদদের পূর্ণ তালিকাও হয়নি।
হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে যারা বেঁচে গেছেন তারাও পাননি সরকারিভাবে নূন্যতম সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা। এদের অনেকেই অর্ধাহারে-অনাহারে দিন যাপন করছে। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এদের সাহায্যে কেউ এগিয়ে না এলেও তাদের একটাই দাবি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হউক।
এদিকে সোমবার মাকালকান্দি গণহত্যা দিবস উপলক্ষে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সমবায় সমিতির উদ্যোগে আলোচনা সভা, পুষ্পস্তবক অর্পণসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এসব কর্মসূচিতে সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আব্দুল মজিদ খান, জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী পাঠান, উপজেলা কমান্ডার আব্দুল খালেকসহ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধাগণ উপস্থিত ছিলেন।
স্বজন হারানো পরিবারগুলো এখনো নীরবে নিভৃতে কাঁদেন। বিচার চান যুদ্ধাপরাধীদের। যাদের সহায়তায় তাদের সর্বস্ব হারাতে হয়েছে। পাশাপাশি তাদের পুনর্বাসনে কামনা করেছেন সরকারি সহায়তারও।
সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন/বিএ