সড়কে হাহাকার
রাজধানীজুড়ে যেন পায়ে হাঁটা মানুষের মিছিল। সড়কে সড়কে হাজারও মানুষের ভিড়। কিন্তু পরিবহন নেই একটিও। গণপরিবহনের জন্য হাহাকার বইছে রাজধানীর সড়কগুলোতে। সকাল থেকে পরিবহন না পেয়ে দিশেহারা রাজধানীবাসী। দীর্ঘ অপেক্ষার পরও গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে ঢাকা নগরী। পরিবহন সংকটে স্থবির হয়ে পড়েছে গোটা দেশও।
সংসদে সদ্য পাস হওয়া ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ এর কয়েকটি ধারা সংশোধনসহ আট দফা দাবি আদায়ে সারাদেশে ডাকা ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘটে এমন হাহাকার রাজধানীর সড়কগুলোতে। কোথাও কোনো সাধারণ পরিবহনের দেখা মিলছে না। যেটুকু মিলছে তা হলো বেশি ভাড়ার রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা ও বিআরটিসির হাতেগোনা কয়েকটি গাড়ি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কেউ কেউ পিকআপে চেপে বসেছেন গন্তব্যে যেতে। কেউ মোটরসাইকেল, আবার কেউ রিকশায় চেপে বসেছেন। রোগীদেরও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ যাত্রীই পায়ে হেঁটে রওনা দিচ্ছেন।
বনশ্রী ই ব্লক থেকে উত্তরা যাবেন ফরিদুল ইসলাম। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফরাজী হাসপাতালের সামনে। কোনো গাড়ির দেখা পাচ্ছিলেন না। পরে অনেকটা বাধ্য হয়েই বেশি ভাড়া দিয়ে রিকশায় রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত চলে আসেন। এরপর একটি ফাঁকা পিকআপ পেয়ে দৌড়ে গিয়ে তাতে লাফিয়ে ওঠেন। কোনো রকম পার পেয়ে যান তিনি। এর রকম হাজারও যাত্রীকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
তবে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের। কল্যাণপুরে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকা মোহাম্মদপুর রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী বিথী আজম বলেন, সকালে ক্লাস রয়েছে। যথাসময়ে পৌঁছাতে পারবো কিনা বলেতে পারছি না। রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই।
কল্যাণপুরের আরেক যাত্রী মেহেদী হাসান বলেন, হঠাৎ করে শ্রমিকদের ডাকা পরিবহন ধর্মঘটে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। দিশহারা হয়ে পড়ছে সাধারণ জনগণ। ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।
কল্যাণপুরে ৩০ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানজিম (২৭)। যাবেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। তিনি বলেন, রাস্তায় কোনো সাধারণ পরিবহন নেই। যে দু-একটা বিআরটিসির গাড়ি আসছে তাতে ওঠার কোনো সুযোগ নেই।
বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকে কর্মরত লায়লা আনজুম বলেন, ধর্মঘট এমন হবে ভাবতে পারিনি। মতিঝিল যাবো। অথচ রিকশায় ভাড়া চাচ্ছে ৪০০ টাকা। বাধ্য হয়ে বেশি ভাড়াতেই যেতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকে আজ (রোববার) সকাল ৬টা থেকে শুরু হওয়া এ ধর্মঘট পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত চলবে। এই সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে লাগাতার ধর্মঘটের ঘোষণাও দিয়েছে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ।
শনিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা কয়েক হাজার পরিবহন শ্রমিক সমাবেশে অংশ নেন। সেখানে সংসদে পাস হওয়া ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর কয়েকটি ধারা সংশোধন এবং আট দফা দাবি পূরণের আহ্বান জানানো হয়। ঘোষণা করা হয় ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট কর্মসূচি।
এ ব্যাপারে রোববার সকালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা আট দফা দাবি উত্থাপন করেছি। সরকারের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আমাদের দাবি মানা হয়নি। যে কারণে আমরা পাস হওয়া আইনের কিছু ধারার সংশোধন ও উত্থাপন করা আট দফা দাবি বাস্তবায়নে ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতি ঘোষণা করেছি। এই কর্মসূচি সারাদেশে একযোগে শুরু হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই কর্মসূচিতে বিক্ষোভ মিছিল হবে, তবে পিকেটিং করা হচ্ছে না। আমাদের কর্মবিরতির সুযোগ নিয়ে থার্ডপার্টি, পুলিশ কিংবা অন্য কোনো পক্ষ যদি বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করে তবে তা রুখে দেয়া হবে। সেজন্য আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিবহন শ্রমিকরা সড়কে রয়েছি।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত শনিবারের বিক্ষোভ সমাবেশে পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী মোতাহের হোসেন বলেন, ২৮ ও ২৯ অক্টোবর সারাদেশে পূর্বনির্ধারিত কর্মবিরতি পালিত হবে। যদি এর মধ্যে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর শ্রমিক স্বার্থবিরোধী ধারা সংশোধন না করা হয় তাহলে ৩০ অক্টোবর থেকে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট পালন করা হবে।
এ সময় সংগঠনটির সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াজিউদ্দিন খান ও সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর পক্ষে আট দফা দাবি এবং কর্মসূচি সংবলিত লিফলেট বিতরণ করা হয়।
লিফলেটে বলা হয়, গত ১৯ সেপ্টেম্বর ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮' জাতীয় সংসদে পাস হয়। ফেডারেশন দীর্ঘদিন ধরে যুগোপযোগী আধুনিক ও উন্নত সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের দাবি করে আসছে। সেই দাবি গুরুত্বসহ বিবেচনায় নিয়ে সরকার আইন পাস করলেও বেশকিছু ধারা শ্রমিক স্বার্থের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। যে কারণে পরিবহন শ্রমিকদের চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আইনে সড়ক দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা হিসেবে গণ্য না করে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। আমরা জানি, দুর্ঘটনা পরিকল্পিতভাবে ঘটে না কিন্তু অপরাধ পরিকল্পিতভাবেই ঘটে।
পরিবহন শ্রমিকদের আট দফা দাবি হলো :
১. সড়ক দুর্ঘটনায় মামলা জামিনযোগ্য করতে হবে;
২. শ্রমিকদের অর্থদণ্ড ৫ লাখ টাকা করা যাবে না;
৩. সড়ক দুর্ঘটনা তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখতে হবে;
৪. ড্রাইভিং লাইসেন্সে শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণি করতে হবে;
৫. ওয়েটস্কেলে (ট্রাক ওজন স্কেল) জরিমানা কমানোসহ শাস্তি বাতিল করতে হবে;
৬. সড়কে পুলিশের হয়রানি বন্ধ করতে হবে;
৭. গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের সময় শ্রমিকদের নিয়োগপত্র সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সত্যায়িত স্বাক্ষর থাকার ব্যবস্থা করতে হবে;
৮. সব জেলায় শ্রমিকদের ব্যাপকহারে প্রশিক্ষণ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করতে হবে এবং লাইসেন্স ইস্যুর ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করতে হবে।
এএসএস/জেইউ/বিএ/পিআর