অনিয়ন্ত্রিত বিমানের ‘গ্রাহক সেবা বিভাগ’
ইচ্ছেমতো ফ্লাইটে দায়িত্ব বণ্টন, সেচ্ছাচারিতা আর অনিয়মের কারণে গোটা বিমানের ব্যবস্থাপনাই এখন প্রশ্নের মুখে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিমানের গ্রাহক সেবা। মূলত গুটিকয়েক সুবিধাভোগীর জন্যই এত অনিয়ম বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বিমানের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাবেক পরিচালকসহ অধিনস্ত দুই শীর্ষ কর্মকর্তার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি আর প্রভাবের কাছে জিম্মি বাংলাদেশ বিমানের গ্রাহক সেবা বিভাগ। এদের একজনকে (ডিজিএম নুরুজ্জামান রঞ্জু) সোমবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ভিভিআইপি ফ্লাইটে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে গ্রাউন্ডেড করা হয়েছে।
বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস শাখার বিভিন্ন স্তরে কথা বলে জানা যায়, গ্রাহক সেবা বিভাগের বিতর্কিত ডিজিএম নুরুজ্জামান রঞ্জুর বিরুদ্ধে লন্ডনের এক হোটেলে এক কেবিন ক্রুকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে চিফ পার্সারের দায়িত্ব পালনে যথাযথ যোগ্যতা না থাকলেও দীর্ঘদিন থেকে সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি তিনি একাই ভিভিআইপি ফ্লাইটে এ দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
বিমানের গ্রাহক সেবা বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জাগো নিউজকে জানান, গ্রাহক সেবা বিভাগের সদ্য বিদায়ী পরিচালক এর প্রশ্রয়ে ডিজিএম নুরুজ্জামান রঞ্জু দায়িত্বে বেপরোয়া ছিলেন। গত কয়েক মাসে মাদক বহনের অভিযোগে কেবিন ক্রু পপি, উর্মি ও কান্তার ডিমোশন হলেও তিনি পুনরায় তাদের সিনিয়রটি পূনর্বহাল করেন। এ ছাড়া তার সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে এমন কজন ক্রুকে দিয়ে ফ্লাইট না করিয়ে মাসের পর মাস অফিসে বসিয়ে রেখে সুবিধা দিয়েছেন। এতে বিমানের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। কারণ অফিসে বসেই ক্রু হিসেবে তারা বেতন, পোষাক, ওয়াশিং, জেট অ্যালাউন্স, সুটকেস, হাতব্যাগ , শাড়ি , উইন্টার জ্যাকেট ইত্যাদি সুবিধা ভোগ করছেন। আবার কিছু ক্রু তাকে ম্যানেজ করে বাসায় বসে মাসের পর মাস অসুস্থতার কথা বলে বেতন নিচ্ছেন।
অপরদিকে, ইউনিয়নের নেতা বা সদস্যদের বউ যারা কেবিন ক্রু তাদের এক বা দুই টাইপ এয়ারক্রাফটে ডিউটি করানো হয়। সব রুটে তাদের ফ্লাইট করানো হয় না। তাদের দিয়ে অবশ্যই তিন ধরনের ফ্লাইট করনোর অথবা প্রত্যেককে তিন মাস পর পর বিএটিসিতে ট্রেনিংয়ে পাঠানোর কথা থাকলেও তা করা হয় না। ফাহমিনা, রীতা, ফারিহা, বর্নি, তানভির, নিনা, পপি, আরজুসহ বেশ কজন রয়েছে এ তালিকায়।
আইডি কার্ডের মেয়াদ কয়েক মাস আগেই শেষ হওয়ায় সম্প্রতি লন্ডন ফ্লাইট করার পর হিথ্রো এয়ারপোর্ট অথরিটি-হাল বিতর্কিত চিফ পার্সার পপির বিষয়ে আপত্তি জানালেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো স্বজনপ্রীতি দেখিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (ভিভিআইপি) ভ্রমণে স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল স্থানে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ বিমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োজিত করা হচ্ছে। ফলে ভিভিআইপি ফ্লাইটে ঘটছে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ও ৫ মার্চ জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বিমানের বেশকিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে ভিভিআইপি ফ্লাইটের জন্যে কালো তালিকাভুক্ত করে ব্যবস্থা নিতে বলে। কিন্তু বিমান প্রশাসন সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে উল্টো তাদের কাউকে আরও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসায়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৬-১৯ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিউনিখ সফর উপলক্ষে শাহজালালে কর্মরত বিমানের গ্রাহক সেবা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আতিক সোবাহানসহ ছয় ব্যক্তিকে ভিভিআইপির নিরাপত্তা জনিত স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল স্থানে নিয়োজিত না রাখতে নির্দেশনা দেয়।
ওই তালিকায় থাকা সিকিউরিটি বিভাগের ম্যানেজার মো. নুরুজ্জামান মণ্ডল (সম্প্রতি অবসরে গেছেন, পি নং- ৩২৬৫৯), একই বিভাগে কর্মরত মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম (পি নং- ৩৫১২৭), নিরাপত্তা তত্ত্বাবধায়ক মো. শহিদুল্লাহ খান (পি নং- ৩৫১৫৩), নিরাপত্তা সহকারী মো. কামরুজ্জামান (জি নং- ৫০৩৫৪) ও নিরাপত্তারক্ষী মো. আলমগীর হোসেনের (ডি নং- ১০৬২৯) নামও ছিল।
গত বছরের ৫ মার্চ একই সংস্থার ইস্যু করা অপর এক চিঠিতে ৬-৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর জাকার্তা সফর নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে আতিক সোবাহানসহ আরও ১২ ব্যক্তিকে ভিভিআইপির নিরাপত্তাজনিত স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল স্থানে নিয়োজিত না রাখতে নির্দেশনা দিলেও বিমান তাদের এখনো ভিভিআইপির নিরাপত্তায় জড়িত বিভাগে বহাল রেখেছে।
নির্দেশনায় আতিক সোবাহান ছাড়াও কেবিন ক্রু আশরাফুল হাসান (সি নং- ৩৭০২), পজিশনিং স্ট্যান্ডবাই ক্রু জুবাইদা গুলশান আরা (পি নং- ৩৫৫০৪), কেবিন ক্রু কাজী রিবিয়া সুলতানা কান্তা (পি নং- ৩৪৪২৮), পজিশনিং ফ্লাইটের ক্রু নাহিদ সুলতানা তৃষা (সি নং- ৩৭৫৪), পজিশনিং ফ্লাইটের ক্রু আকাশ (সি নং- ৩৭৬৮), পজিশনিং ফ্লাইটের ক্রু হাসিবুল হক (সি নং- ৩৭৬৯), পজিশনিং ফ্লাইটের ক্রু সিফাত (সি নং- ৩৭৩২), পজিশনিং ফ্লাইটের স্ট্যান্ডবাই ক্রু রাখি (সি নং- ৩৭২৫), স্ট্যান্ডবাই অপারেশন সহকারী ম্যানেজার মো. রফিকুল ইসলাম (পি নং- ৩২১৭৬), জিএসই বিভাগের অপারেটর মো. আমিনুল ইসলাম (পি নং- ৩৫৯৩৬) ও বিমান বিভাগের অপারেটর মো. আক্তার হোসেনের (পি নং- ৩৫৭২৪) নাম রয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনার পর কয়েকজন কেবিন ক্রুকে ভিভিআইপি ফ্লাইট থেকে বাদ দেয়া হলেও গ্রাহক সেবা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল পদে কালো তালিকাভুক্ত ব্যক্তিকেই রাখা হয় দীর্ঘ সময়। আতিক সোবাহানকে দিয়েই ভিভিআইপি ফ্লাইটের ফাইনাল ক্রু পজিশন, এফসিপি এবং খাবারের তালিকা তৈরির কাজ করানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিমানের গ্রাহক সেবা বিভগে সদ্য যোগদান করা পরিচালক মমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনা অবশ্যই অনুসরণ করা হবে। কারও বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলা ও অনিয়মের অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
বিমানের অধিকতর স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল স্থানে কেন বিতর্কিতরা- এমন প্রশ্নের জবাবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এ এম মোসাদ্দিক আহমেদ বলেন, কেবিন ক্রু মাসুদা মুফতির মাদক গ্রহণের প্রমাণ পাওয়ায় তাকে রোববার গ্রাউন্ডেড করা হয়েছে। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ফ্লাইট সার্ভিসের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার নুরুজ্জামান রঞ্জুকে গ্রাউন্ডেড করা হয়েছে। ঘটনায় বিভাগীয় তদন্ত চলছে।
আরএম/এএইচ/আরআইপি