রোকসানার কান্না কে থামাবে!
বার্ন ইউনিটের শিশু ওয়ার্ডে তখন চারজন রোগী। শুয়ে থাকা আগুনে পোড়া অন্য তিন শিশু অনেকটাই শান্ত। গোটা ওয়ার্ডে যেটুকু আর্তনাদ, তা কেবল ৯নং বেড থেকেই ভেসে আসছে।
রোকসানার শরীরের পোড়া দাগ শুকিয়ে আসছে প্রায়। তবে শরীরের পোড়া বা কামড়ানোর জায়গাগুলো কালসিটে এখনও। এমন যন্ত্রণা শুকানো ঘা থেকে প্রকাশ পাবার কথা নয়!
কাছে যেতেই ঘোর কেটে গেল। বালিশে মাথা আচড়ে মারছে। ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে পরক্ষণেই হাত-পা ছুড়ে দিচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা যেন চোখ বেয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মানসিক ভারসাম্য হারানো মাথার যন্ত্রণা থেকেই এমন আর্তনাদ করছে।
রোকসানার আর্তনাতে বাবা রাসেল শেখ বাকরুদ্ধ। মেয়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছেন রাসেল আর নিজের চোখের পানি মুছছেন। একমুঠো খাবারের আশায় মেয়েকে ঢাকায় পাঠিয়ে বাবা রাসেল আজ পাগলপ্রায়।
রোকসানার বাবা রাসেলের প্রশ্ন ‘কী অপরাধ করেছিল, আমার শিশু বাচ্চা রোকসানা? কী কারণে নির্যাতন করল, তাও জানতে পারলাম না। আমার রোকসানার কান্না কে থামাবে?
রোকসানা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক ইউনিটের ২য় তলার (আইসিইউ) শিশু ওয়ার্ডের ৯ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন। বৃহস্পতিবার হাসপাতালে তার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে যাওয়া হয় জাগো নিউজের পক্ষ থেকে। হাসপাতালের বেডের পাশে দাঁড়িয়েই কথা হয় বাবা মোহাম্মদ রাসেলের শেখের সঙ্গে।
আট মাস আগের কথা। ঢাকার ওয়ারী এলাকার ইলিয়াস হোসেন পলাশ নামের এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করাতে নিয়ে আসেন তার স্ত্রী সোনিয়া। রোকসানার বাড়ি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার বাহিরপাড়া গ্রামে। একই গ্রামের সালেহা বেগম নামের এক নারী মূলত রোকসানার সন্ধান দেন।
বাবা রাসেল শেখ রাজি না থাকলেও রোকসানার মাকে ভুলিয়ে ম্যানেজ করেন সোনিয়া। প্রথমে ছয় মাস ফোনে কথা বলার সুযোগ দিলেও রোকসানাকে দিয়ে কী কাজ করানো হতো, তার কিছুই জানতে পারেননি রাসেল শেখ। গেল রোজায় সোনিয়ার ভাইয়ের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় রাসেল শেখের। এরপর আর যোগোযোগ করতে পারেননি রোকসানার বাবা।
গত আগস্টে রাসেল শেখ ফের ফোন পায় সোনিয়ার ভাই ইব্রাহিমের কাছে থেকে। রোকসানা অসুস্থ জানিয়ে শেখ রাসেলকে ঢাকায় আসতে বলে সে। তখন ধানমন্ডির এক হাসাপাতালে ভর্তি রোকসানা। প্রথমে রাসেল শেখকে মেয়ের কাছে যেতে বারণ করা হয়। পরে বাবা-মেয়েকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে সটকে পড়ে সোনিয়া-ইব্রাহিম গ্যাং। এরপর নড়াইল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় গুরুতর অসুস্থ রোকসানাকে। সেখানে অবস্থার আরও অবনতি হলে গত ২৭ আগস্ট ভর্তি করা হয় ঢামেকে।
দীর্ঘ চিকিৎসার পরেও রোকসানার অবস্থার উন্নতি ঘটছে না। দিনের পর দিন নির্যাতনে ১২ বছরের রোকসানা ভারসাম্য হারিয়ে এখন কথাও বলতে পারছে না। পলাশ-সোনিয়ার পরিবারে সকল পাষণ্ডতার শিকার এই অবুঝ শিশু।
আসলে কী ঘটেছে রোকসানার সঙ্গে! তার হিসাব মেলাতে পারছে না রাসেল শেখ। শরীরের সর্বত্রই আগুনের ছ্যাঁকা। পোড়াক্ষত আপাদমস্তক। কামড়ের দাগ মুখ, পিঠ, পেটে। হিংস্র দাঁতের কামড়ের দাগ রয়েছে রোকসানার তলপেটেও। বাবা রাসেল শেখের ধারণা, নির্মম যৌন নির্যাতন চালাতে গিয়েই শরীরের সর্বত্র কামড়িয়েছে পাষণ্ডরা। যদিও গৃহকর্ত্রী সোনিয়া নিজে নির্যাতনের কথা শিকার করেছে রিমান্ডে।
এ ঘটনায় গত ২২ আগস্ট অভিযুক্ত ইলিয়াস হোসেন, তার স্ত্রী সোনিয়া, সোনিয়ার ভাই ইব্রাহিম ও সরবরাহকারী সালেহা বেগমের নাম উল্লেখ করে লোহাগড়া থানায় মামলা দায়ের করেন রোকসানা বাবা রাসেল শেখ।
গত ১১ সেপ্টেম্বর নড়াইল আদালতে হাজির হন গৃহকর্ত্রী সোনিয়া। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে জেল হাজতে পাঠিয়েছেন। নড়াইল চিফ জুডিশিয়াল আদালতের বিচারক (লোহাগড়া আমলি আদালত) মো. জাহিদুল আজাদ এই রায় দেন।
এএসএস/বিএ