মেধাবীদের ক্যাম্পাসে এরা কারা?
তিন বছর ধরে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয়া কলেজগুলোর মধ্যে সবার সেরা চট্টগ্রাম কলেজ। দেশের সরকারি কলেজগুলোর মধ্যেও চট্টগ্রাম কলেজের অবস্থান সেরাদের কাতারে। কিন্তু মেধাবীদের সেই ক্যাম্পাসে গত দু’দিন ধরে চলছে অস্ত্রের মহড়া। ক্যাম্পাসে শুটারগান, পিস্তল ও রামদার মতো ভয়ঙ্কর অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরছে বহিরাগতরা। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কলেজের ২২ হাজার শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা। দেশসেরা কলেজের শিক্ষার পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো শঙ্কিত তারা।
সর্বশেষ গতকাল বুধবার দুপুরে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের বিরোধিতার জেরে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় মেধাবীদের এই ক্যাম্পাস। বিরোধ কলেজ কমিটি নিয়ে হলেও সংঘর্ষে যোগ দেয় বিপুল সংখ্যক বহিরাগত তরুণ। তাদের কারও কারও হাতে রামদা–কিরিচ দেখা গেছে। পরে উভয় পক্ষের কয়েক দফা মিছিলের পর শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এর মধ্যে তিনটি ককটেলের বিস্ফোরণও হয়।
বেলা পৌনে ১টার দিকে গণি বেকারি মোড়ে কাপড়ে মুখ ঢাকা ১৫ থেকে ২০ বহিরাগত যুবক অস্ত্র হাতে রাস্তায় নেমে আসে। এ সময় সাদা শার্ট পরিহিত এক যুবককে শুটারগান উঁচিয়ে গুলি ছুঁড়তে দেখা যায়। হাফপ্যান্ট পরা কয়েকজন যুবককে পিস্তল, রামদা ও ছোরা নিয়ে মহড়া দিতেও দেখা যায়।
এসব ঘটনায় চট্টগ্রাম কলেজ ও হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন। অনেকের আহত হওয়ার খবরও পাওয়া যায়। শিক্ষার্থী ও পথচারীদের পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ।
তবে চট্টগ্রাম কলেজে অস্ত্রের মহড়া গতকালই প্রথম নয়। দেশসেরা কলেজটিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের ভেতর দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলে আসছে সেই ২০১৫ সাল থেকে। ছাত্রলীগের বিবাদমান গ্রুপের মধ্যে গত তিন বছরে কমপক্ষে অর্ধশতবার সংঘর্ষ হয়েছে। ব্যাহত হয়েছে শিক্ষার পরিবেশ। ছাত্র সংগঠনটির এমন আচরণে বিরক্ত হয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এ কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কার্যক্রম নেই বলে ঘোষণা দিয়েছিল।
এদিকে সংঘর্ষ এড়াতে গত আড়াই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের চারটি ছাত্রাবাস। ফলে শত শত শিক্ষার্থী ছাত্রাবাসের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিন চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, গত দু’দিনের টানা সংঘর্ষের পর অন্যান্য দিনের তুলনায় ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি কম। কলেজ গেট ও সড়কে রয়েছে পুলিশের পাহারা। আতঙ্কিত অভিভাবকরা বিশেষ করে ছাত্রীদের নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন কলেজের আশপাশে। তাদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ, কখন আবার সংঘর্ষ বেধে যায়।
উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস জাগো নিউজকে বলেন, আর কয়েক মাস পরই টেস্ট পরীক্ষা। এখন ক্লাস করাটা খুবই জরুরি। কিন্তু ক্যাম্পাসের যে অবস্থা তাতে ক্লাসে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না। কিছুদিন পরপর ছাত্র সংগঠনগুলোর মারামারির কারণে পড়ালেখা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সম্প্রতি ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের উপস্থিতি এবং প্রকাশ্যে অস্ত্র বহনের মতো ঘটনা শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
সাবরিনা আক্তার নামে এক অভিভাবক বলেন, সবার কাছে শুনেছিলাম চট্টগ্রাম কলেজ ভালো। মেয়েকে চট্টগ্রামের সেরা কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি করাতে পেরে নিজের কাছে ভালো লেগেছিল। কিন্তু এখন মেয়েকে কলেজে পাঠিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকি, মেয়েকে নিয়ে ভালোভাবে বাসায় ফিরে যেতে পারবো তো? দেশসেরা কলেজে এভাবে গোলাগুলি হতে পারে, কল্পনাও করিনি!
গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে প্রায়ত আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী ও ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি নেয়া নুরুল আজিম রনির অনুসারী হিসেবে পরিচিত মাহমুদুল করিমকে সভাপতি এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির অনুসারী সুভাষ মল্লিক সবুজকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রথমবারের মতো এই কলেজে ছাত্রলীগের কমিটির অনুমোদন দেয়া হয়।
কমিটির ২৫ সদস্যের মধ্যে ছয়জন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং চারজন নুরুল ইসলামের অনুসারী। বাকি ১৫ জন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী। নতুন এ কমিটি অনুমোদন দেন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর। তারাও মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন সমর্থিত ছাত্রলীগ নেতাদের একজন খোরশেদ। তিনি অভিযোগ করেন, ‘৪০ লাখ টাকার বিনিময়ে মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এই কমিটি ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে কমিটির ছয়জন সদস্য পদত্যাগ করেছেন। বর্তমান কমিটিতে কোনো ছাত্রলীগ নেই। শিবির-ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল- এমন ছাত্রদেরও কমিটিতে রাখা হয়েছে।’
নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে যাদের অবস্থান ভালো তাদেরকে আমরা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করেছি। শিবির-ছাত্রদল বলে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তারা তো ক্যাম্পাসেই রাজনীতি করে আসছিল। এতোদিন তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি, এখন কেন?’
জামায়াত-শিবিরের ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিতি পাওয়া চট্টগ্রাম কলেজের শহীদ মিনারে ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর ফুল দেয়াকে কেন্দ্র করে কলেজ ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষ হয়। সেসময় নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে চট্টগ্রাম কলেজে প্রবেশ করে ছাত্রলীগ। এরপর থেকে কলেজে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নুরুল আজিম রনির অনুসারীদের সঙ্গে যুবলীগ নেতা নুর মোস্তফা ওরফে টিনু ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরের অনুসারীদের বিরোধ চলে আসছে। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষে জড়ায় তারা।
২০১৬ সালের ১৯ জুন আধিপত্য বিস্তার ও ভর্তিচ্ছুদের স্বাগত জানানোকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। নগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীদের মধ্যে ওই সংর্ঘষ হয়। সেদিনও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে ক্যাম্পাসে। সাংবাদিকসহ আহত হন আটজন।
২০১৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইংরেজি বিভাগের সেমিনার কক্ষে বসা নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ ফের সংঘর্ষে জড়ায়। আহত হন চারজন। ২০১৭ সালের ১২ জুলাইয়ের সংঘর্ষে আহত হন ১২ জন।
সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের এভাবে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়ানো এবং কলেজটির শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্ন ঘটার বিষয়ে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ এ কে ফজলুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘কলেজটি দেশসেরা এবং মেধাবীদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত। এখানকার শিক্ষার পরিবেশ কেউ নষ্ট করুক তা আমরা চাই না। সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু ধৈর্য ধরতে হবে।’
আবু আজাদ/এমএআর/জেআইএম