সিরাজ মাস্টারের ফাঁসির রায়ে বাগেরহাটে উল্লাস


প্রকাশিত: ০৩:৩৪ পিএম, ১১ আগস্ট ২০১৫

বাগেরহাটের কুখ্যাত রাজাকার কসাই সিরাজ মাস্টারের ফাঁসি ও তার সহযোগী আকরাম হোসেনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়ায় আন্দন মিছিল করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। রায় ঘোষণার পরপরই বাগেরহাট পুরাতন কোট চত্ত্বর এলাকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনে অপেক্ষমান মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দে ফেটে পড়েন। তারা উল্লাস প্রকাশ করে রাজাকার সিরাজ মাস্টারের ফাঁসি অবিলম্বে কার্যকরের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। এসময় জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে এসে বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাগেরহাট -৪ আসনের সংসদ ডা. মোজাম্মেল হোসেন তাদের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করেন। পরে মিছিলে যোগ দেন বাগেরহাট ২ আসনের সংসদ সদস্য মীর শওকাত আলী বাদশাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।  এরপর জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে মুুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে বিশাল মিছিল বাগেরহাট শহর প্রদক্ষিণ করে।

মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার শাখারীকাঠি বাজারে ৪২ জনকে গণহত্যার শিকার রঘুদত্তকাঠি গ্রামের শহীদ জিতেন্দ্র নাথ দাসের ছেলে নিমাই চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ২০০৯ সালে কচুয়া থানায় কুখ্যাত এই রাজাকার কমান্ডারসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে।

বাগেরহাটের কুখ্যাত রাজাকার শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার ও খান আকরাম হোসেনের বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এটি ২১তম রায়। এই রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই আদালতে আপাতত আর কোনো মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ থাকলো না।

গত বছরের ২৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তদন্ত সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বাগেরহাটে এসে তিন দিন ধরে তদন্ত  করেন। তদন্তকালে কর্মকর্তারা মামলার বাদী ও শহীদ পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন সাক্ষির সাক্ষ্য নেওয়ার সময় কসাই সিরাজের বিরুদ্ধে আটশতাধিক হত্যা-গণহত্যার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেন।

তদন্তে কর্মকর্তারা বাগেরহাট সদর, রামপাল ও কচুয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের অভিযোগ পান সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার ওরফে কসাই সিরাজের বিরুদ্ধে। পরে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার তদন্ত দল দীর্ঘ তদন্ত শেষে সিরাজ মাস্টার, খাঁন আকরাম হোসেন ও আব্দুল লতিফ তালুকদারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করে।

২০১৪ সালের ১০ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।  এ ঘটনার কিছুদিন পর ২১ জুলাই সোমবার রাত ১১টায় বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা গ্রাম থেকে এই কুখ্যাত রাজাকারকে গ্রেফতার করা হয়। ওই রাতে সে তার চাচাশ্বশুর মৃত. মোসলেম পাইকের পরিত্যক্ত একটি খুপড়ি ঘরে রাতিযাপন করার সময়ে বাগেরহাট মডেল থানা পুলিশ সিরাজ মাস্টারকে ধরতে সক্ষম হয়। এর আগে বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানা পুলিশ গত বছর ১১ জুন পলাতক আসামি আবদুল লতিফ তালুকদারকে এবং ১৯ জুন রাজশাহী থেকে আকরাম হোসেন খানকে গ্রেফতার করে ট্রাইব্যুনালে সোপর্দ করে।

কে এই কসাই সিরাজ : ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণকারী বাগেরহাট সদরের গোটাপাড়া গ্রামের হারেজ উদ্দিনের ছেলে শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাষ্টার মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা একে এম ইউসুফের বামহস্ত হিনেবে পরিচিত ছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী সিরাজুল হক খুলনার সেন্ট জোসেফ স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক ও রাজাকার বাহিনীর তৎকালীন বাগেরহাট মহাকুমা ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীয় বাগেরহাট পিচ কমিটির নেতা রজব আলী ফকির, শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার এবং আকিজ উদ্দিন ছিলেন অন্যতম ক্ষমতাধর। বাগেরহাটের জেলা পরিষদের ডাকবাংলো ছিলো রাজাকারদের অন্যতম ঘাটি। ভৈরন নদীর পাশে এই বাংলো হওয়ায় বিভিন্ন এলাকার নীরিহ মানুষদের ধরে এনে রাতে বাংলোয় বসেই অত্যাচার করতো সিরাজ ও তার অনুসারীরা। সকালে ডাকবাংলোর সামনে দিয়ে প্রবাহিত বাগেরহাট শহরের ভৈরব নদী পাড়ে নিয়ে কসাই সিরাজ নিজ হাতে জবাই করে তাদের হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিতো। তার আগে তাদের বুক চিরে কলিজা বের করে দেখতো। কুখ্যাত কসাই সিরাজ প্রতিদিন সকালে নিজ হাতে মানুষ জবাই না করে নাস্তা পর্যন্ত গ্রহণ করতো না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিরাজ মাস্টার বাগেরহাট শহরের ডাকবাংলা ঘাটে মুক্তিকামী শত শত মানুষকে ধরে এনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করার কারণে রাতারাতি সিরাজ মাস্টার কসাই সিরাজ মাস্টার হিসেবে কুখ্যাতি পায়। স্বাধীনতার পর-পরই মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম খোকনের ‘রফিক বাহিনী’র যোদ্ধারা এই কুখ্যাত কসাই সিরাজ মাস্টারকে আটক করে। একই সময়ে আটক হয় রাজাকার আকিজ উদ্দিনকেও। তখন বাগেরহাট শহরে টিকেটের বিনিময়ে সাধারণ জনগনকে এই কুখ্যাত দুই রাজাকার লোহার খাচায় আটকে রেখে প্রদর্শনীর জন্য টিকিট দেয়া হয়েছিল। তখন কসাই সিরাজ মাস্টারকে দেখে তার গায়ে থুথু মেরে ঘৃণা প্রকাশ করতো। দেশ স্বাধীনের পর দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দি ছিলেন এই রাজাকার। পরে তিনি মুক্তি পেয়ে যান। মুক্তিরপর নিজ এলাকা গোটাপাড়া গ্রামে ফিরে আসেনি। পরে বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা গ্রামে শ্বশুর বাড়ি এলাকায় বাড়ি তৈরি করে সেখানে বসবাস করতেন। মুক্তিপাবার পর কসাই সিরাজ দম্ভোক্তি করে বলত বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, হলে আমি সিরাজ মাস্টার বাংলাদেশের আলোবাতাসে ঘুরে বেড়াতে পারতাম না।

সাত অভিযোগ : সাত অভিযোগের মধ্যে ছয়টিতে সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারকে আসামি করা হয়। একটি অভিযোগে আসামি কেবল আকরাম ও লতিফ।

অভিযোগ-১: ১৯৭১ সালের ১৩ মে দুপুর ২টার দিকে রাজাকার বাহিনীর বাগেরহাট সাব ডিভিশনের তৎকালীন ডেপুটি কমান্ডার শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার ও রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে ৫০-৬০ জন রাজাকার এবং বেশ কিছু স্বাধীনতাবিরোধী বাগেরহাট জেলার রঞ্জিতপুর গ্রামে ঘিরে ফেলে। তারা বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। ওই সময় সিরাজুল হক এবং তার সহযোগীরা প্রায় ৪০-৫০ জন হিন্দুকে হত্যা করে। এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট ও অগ্রিসংযোগসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।

অভিযোগ-২: স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার ডাকরার কালী মন্দিরে ভারতের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার জন্য জড়ো হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই-তিন হাজার লোক। এ খবর পেয়ে তাদের হত্যার জন্য সিরাজ মাস্টার ও রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন সশস্ত্র রাজাকার ডাকরা গ্রামে যায় এবং নির্বিচারে গুলি চালায়। এরপর কালী মন্দিরে গিয়ে সেখানে জড়ো হওয়া মানুষদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ছয় থেকে সাতশ জনকে হত্যা করে তারা। ১৯৭১ সালের ২১ মে বেলা ৩টা থেকে ৫টার মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। সে সময় সিরাজ মাস্টার ও সহযোগীরা ওই এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়।

অভিযোগ-৩: একাত্তরের ১৮ জুন সকাল ১০টার দিকে সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন পাকিস্তানি সেনা সদস্য এবং ৩০-৩৫ জন সশস্ত্র রাজাকার বেসরগাতী, কান্দাপাড়া গ্রাম এবং কান্দাপাড়া বাজার থেকে ২০ জনকে অপহরণ করে। তাদেরকে কান্দাপাড়া বাজারে আটকে রেখে নির্যাতন করে সিরাজ মাস্টার ও তার সহযোগীরা। তাদের নির্যাতনে ১৯ জন নিহত হন। অপহৃত শেখ সুলতান আলী ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান, যিনি পরে ১৯৮৪ সালে মারা যান। এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে খুন, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।

অভিযোগ-৪: একাত্তরের ১৪ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে সিরাজ মাস্টার ও রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে ১০০-১৫০ জন সশস্ত্র রাজাকার সদর থানার চূলকাঠি গ্রাম, চুলকাঠি বাজার, গণশেমপুর ও আশপাশের এলাকায় হামলা করে এবং প্রায় ৪২টি বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর সিরাজ মাস্টার ও তার সহযোগীরা ওইসব এলাকা থেকে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ করে তাদেরকে চুলকাঠি বাজারে আটকে রাখে। পরে তাদের নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতনসহ অন্যান্য অমানবিক কাজের অভিযোগ আনা হয়।

অভিযোগ-৫: মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫ নভেম্বর দুপুর ৩টার দিকে সিরাজ মাস্টার, স্থানীয় রাজাকার নেতা খান আকরাম হোসেন ও আবদুল লতিফ তালুকদারসহ ৫০-৬০ জন রাজাকার সদস্য মিলে কচুয়া থানার শাঁখারিকাঠি হাটে হামলা চালায়। সেখানে তারা ৪০ জন হিন্দু এবং দুই স্বাধীনতা সমর্থককে আটক করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় তিনজনের বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।

অভিযোগ-৬: একাত্তরের ২২ অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে বিকেল আনুমানিক ৫টার মধ্যে সিরাজ মাস্টার, স্থানীয় রাজাকার নেতা খান আকরাম হোসেন ও আবদুল লতিফ তালুকদার পরিকল্পনা করে স্বাধীনতার পক্ষের লোক হিসেবে পরিচিত টেংরাখালী গ্রামের সতিশ চন্দ্র মণ্ডল, কচুয়া গ্রামের বাবু খান, হাজরাখালী গ্রামের নজরুল ইসলাম শেখ, বারুইখালী গ্রামের মনিন্দ্রনাথ সাহা, চর-টেংরাখালী গ্রামের হাশেম আলী শেখকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে কচুয়া সদরের রাজাকার ক্যাম্পে আটকে রাখে। এরপর সিরাজ মাস্টার তাদের হত্যার নির্দেশ দিলে থানা পরিষদের পাশে নদীর উত্তরপাড়ে নিয়ে গুলি করে তাদের হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তিনজনের বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়।

অভিযোগ-৭: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান শিকদার অন্য চার মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে ভাটখলি ক্যাম্প থেকে বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় মোড়েলগঞ্জ থানার তেলিগাতীতে খান আকরাম হোসেন ও আবদুল লতিফ তালুকদারসহ রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক হন। তারা মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের ওপর নির্যাতন চালায় এবং নদীর কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় খান আকরাম হোসেন ও আব্দুল লতিফ তালুকদারের বিরুদ্ধে অপহরণ ও খুনের অভিযোগ আনা হয়।

এমএএস/এমআরআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।