আনসারুল্লাহকে সন্দেহেই থেমে যায় ব্লগার হত্যার তদন্ত


প্রকাশিত: ০৮:৪৬ এএম, ১১ আগস্ট ২০১৫

সোমবার ১০ আগস্ট। ব্লগার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নিলয় হত্যাকাণ্ডের তৃতীয় দিন। দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের যুগ্ম কমিশনার ও পুলিশের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম। তিনি ধারণা করেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমই নিলয় হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। তাদেরই কোন গ্রুপ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল।

একই দিনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুনতাসিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, `আমরা নিশ্চিত হয়েছি এটি একটি হত্যাকাণ্ড।` অথচ শুক্রবার এ ঘটনার দুই ঘণ্টা পরই ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণ পদ রায় ঘটনাটিকে ‘হত্যাকাণ্ড’ উল্লেখ করে তদন্ত শুরু করার কথা জানান।

তবে এই প্রতিবেদনটি কোন হত্যাকারী সংগঠন কিংবা এর দায় স্বীকার নিয়ে নয়। নিলয় হত্যার চতুর্থ দিন আজ (মঙ্গলবার)। আটক, গ্রেফতারতো দূরের কথা কাউকে শনাক্তই করতে পারেনি পুলিশ। কার্যালয়ে অফিসিয়ালি জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আনা হয়নি কাউকে। তদন্ত তাহলে কোন দিকে চলছে? কাউকে আটক-গ্রেফতার না করে ঘটনাটি ‘হত্যাকাণ্ড’ নাকি ‘আত্মহত্যা’ এনিয়ে কেন বার বার সাংবাদিকদের জানাচ্ছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা? হত্যাকারী যেই হোক, তদন্তে সফলতা না দেখিয়ে বার বার সংগঠনের নাম উচ্চারণ করে কি লাভ?

গত ৬ মাসে রাজধানীতে ৪ ব্লগারকে একইভাবে হত্যা করা হলেও ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এর জড়িত থাকার ‘সন্দেহ’ আর ‘ধারণা’ করা ছাড়া ঘটনা তদন্তে তেমন কোন সফলতাই দেখাতে পারেনি পুলিশ।

অবশ্য পুলিশের এ সন্দেহ `প্রবণতার` শুরু ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ২৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বই মেলা থেকে বাড়ি ফেরার সময় দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে। পরদিনই এর দায় স্বীকার করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। হত্যাকাণ্ড তদন্তে বাংলাদেশে আসে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এফবিআই) সদ্স্যরা। ১১ টি আলামত পরীক্ষার জন্য নিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। হত্যাকাণ্ডের কয়েকমাস আগে অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকি দেয়ায় গ্রেফতার করা হয় ফারাবি শফিউর রহমান নামে এক জঙ্গিকে।

আনসারুল্লাহর পর ৩ মে অভিজিৎ রায়কে হত্যার দায় স্বীকার করে একটি ভিডিও প্রকাশ করে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা।  ৪ মে আবারো সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মনিরুল ইসলাম। এবার বললেন, অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। আল-কায়েদার বাংলাদেশে কোন নেটওয়ার্ক নেই। আনসারুল্লাহ শুধুমাত্র আল-কায়েদাকে অনুসরণ করে।

সেসময়ই অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ৫ জনকে শনাক্ত ও তাদের ছবি সংগ্রহ করার কথা জানান মনিরুল। তবে এ পর্যন্ত কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এমনকি শনাক্তের ৩ মাস পার হয়ে গেলেও পুলিশ এখনো আসামিদের বিস্তারিত পরিচয় বের করতে পারেনি বলে সোমবার জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেছেন ডিবির এক উপ-কমিশনার (ডিসি)। এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমেও প্রকাশ করা হয়নি সেসব ছবি। অভিজিৎ রায়ের মামলাটির তদন্তও ঝুলে রইল আনসারুল্লাহকে সন্দেহের মধ্যে।

অভিজিৎ রায়কে হত্যার পর ৩০ মার্চ একইভাবে খুন হন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু। পালানোর সময় এলাকার কয়েকজন হিজড়া দুই হত্যাকারীকে আটকে পুলিশে দেয়। তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ সন্দেহ প্রকাশ করে, ‘ওয়াশিকুরের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে আনসারুল্লাহ।’

এরপর অবশ্য গ্রেফতারকৃত দুজনকে কয়েক দফায় রিমান্ডে নেয়ার পর তাদের কাছ থেকে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি বলে দাবি করে পুলিশ। মনিরুল ইসলাম এবার দাবি করেন, গ্রেফতারকৃতরা ‘স্লিপার সেল’ এর সদস্য। স্লিপার সেলের সদস্য বলতে সাধারণ মানুষকে বুঝায় যারা লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে কোনো সন্ত্রাসী বা সহিংস কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়। তারা পেশাজীবীও হতে পারে। টাকার বিনিময়ে ফোন পেয়ে এসব কাজ করে। তাদের নির্দেশদাতাকে কখনো সরাসরি দেখে না এই স্লিপার সেলের সদস্যরা।

এই হত্যাকাণ্ডের ৭ দিন আগে সাইফুল ইসলাম নামে এক জঙ্গিকে গ্রেফতারও করে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করার কথা স্বীকার করে সাইফুল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়। তবে নিলয়, অভিজিতের মতো ওয়াশিকুরকে হত্যার তদন্তকাজ সেই ‘আনসারুল্লাহ’ আর ‘স্লিপার সেলেই’ আটকে আছে। গ্রেফতারতো পরের কথা দুজনকে কয়েকদফা রিমান্ডে নিয়ে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীদের নামগুলোও জানতে পারেনি পুলিশ।

একইভাবে মে মাসের ১২ তারিখ সিলেটে খুন করা হলো ব্লগার অনন্ত বিজয় দাসকে। ঘটনাস্থলে গিয়ে সবার আগে অনন্তের রক্তমাখা দেহের ছবি তোলার কারণে একজন ফটো সাংবাদিককে সন্দেহ করে পুলিশ। আটক করে তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।

এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেদিনই ঢাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেন মনিরুল ইসলাম। বললেন ‘এই হত্যাকাণ্ড আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের স্লিপার সেলের কাজ।’ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। তবে পুলিশের এই মুখপাত্র সাংবাদিকদের ইঙ্গিত দিলেন, যদি কেউ গ্রেফতারও হয় তাতেও তেমন আসে-যায় না। কারণ স্লিপার সেলের কেউ কারো সঙ্গে দেখা করে না, চেনে না। তাই তাদের ধরা না ধরা সমান। বাকি ব্লগারদের মতো এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ফলাফলও ‘শূন্য’।

কোন ব্লগার হত্যা মামলার তদন্তে নেই অগ্রগতি, আছে শুধু আনসারুল্লাহকে সন্দেহ। ১৭ মে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেয় পুলিশ। ২৬ মে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে নিষিদ্ধ করা হয় এই জঙ্গি সংগঠনকে।

তবে নিষিদ্ধ শুধু কাগজে কলমে। পুলিশের ভাষ্য মতে, এখনো তারা বাংলাদেশে নিজেদের কর্যক্রম পরিচালনা করছে। এর প্রমাণ অবশ্য পাওয়া গেল নিলয় হত্যাকাণ্ডে। পুলিশ বরাবরের মতো এবারো আনসারুল্লাহর নাম ধারণা করছে।

তবে আমরা সবাই পুলিশের কাছে এই ধারণার বাস্তব রুপ চাই। আনসারুল্লাহর সদস্যদের গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনার অপেক্ষায় রয়েছে দেশের জনগণ। ব্লগারদের হত্যাকাণ্ডে পুলিশ যেন শুধুমাত্র আনসারুল্লাহকে সন্দেহের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আসল অপরাধী পর্যন্ত যেতে পারে সেটাই দেশবাসীর কাম্য।

এআর/এসআইএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।