‘জিয়া-এরশাদ-খালেদার সরকার কৃষকদের সঙ্গে বৈরী আচরণ করেছে’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশের কৃষকরা যখন কৃষিতে সুফল পেতে শুরু করে তখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। ৭৫-পরবর্তী জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকার কৃষকদের সঙ্গে বৈরী আচরণ করেছে। শুধু তাই না, তারা খাদ্য আমদানি নিয়ে ব্যবসা করেছে। তারা কখনই চাননি দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক। তিনি বলেন, তারা চেয়েছে দেশে খাদ্য ঘাটতি। কারণ খাদ্য ঘাটতি থাকলে সাহায্য আসে। সেখান থেকে নেতাকর্মীদের ভালো ব্যবসা হয়। আমদানি করলেও ব্যবসা হয়।
শনিবার (৮ সেপ্টেম্বর) কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ আয়োজিত ষষ্ঠ জাতীয় কনভেনশন-২০১৮ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এ এম এম সালেহ।
সকাল ১০টা ১ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে আসেন। মূলমঞ্চে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের পতাকা উত্তোলন করেন কৃষিবিদ এ এম এম সালেহ। এ সময় জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে দিবসটির শুভসূচনা করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মঞ্চে বসা সকলকে উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে কৃষির উন্নয়নের ওপর একটি প্রামাণচিত্র পরিবেশন করা হয়।
দুই দিনব্যাপী আয়োজিত এ কনভেনশন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকার মোড়ক উম্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন খায়রুল আলম প্রিন্স।
কৃষি উন্নয়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতা লাভের পর অল্প সময়ের মধ্যে জাতির পিতা এ দেশকে গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু তার নেয়া সব উন্নয়ন পরিকল্পনা বন্ধ করে দেয় জিয়াউর রহমান ও তৎপরবর্তী (হুসেইন মুহম্মদ) এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকার।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের উদ্দেশ্যই ছিল এদেশের মানুষকে শোষণ করা। এদেশের মানুষ ভিক্ষা করবে-এটাই চেয়েছিল ক্ষমতা দখলকারীরা।’
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর এদেশকে পিছিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কৃষির উন্নয়নে নানা প্রকল্প-পদক্ষেপ গ্রহণ করে। জমির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অর্থনৈতিকভাবে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি যখন সরকারে ছিল, তখন সারের জন্য কৃষকদের ধরনা দিতে হয়েছে। গুলি খেয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে। কিন্তু এখন সারের জন্য ধরনাও দিতে হয় না। সারই কৃষকের হাতের মুঠোয় পৌঁছে যায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তিন দফায় সারের দাম কমিয়েছে। বর্গাচাষিদের আগে ঋণ দেয়া হতো না। আমরা তাদের জন্যও ঋণের ব্যবস্থা করে দেই। কৃষককে যেন ব্যাংকে আসতে না হয়, বরং ব্যাংকই কৃষকের দ্বারে গিয়ে তাকে ঋণ পৌঁছে দেয়- সেই ব্যবস্থাও করেছি। কৃষিবিদ মির্জা জলিলকে কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বানিয়েছিলাম। ব্যাংকের শাখা সব ইউনিয়নে না থাকার কারণে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে হাটের দিন তাঁবু টানিয়ে কৃষকদের ঋণের টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করেছি।’
দেশ এগিয়ে যাক- এটাই বর্তমান সরকারের লক্ষ্য জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। নিজেদের উৎপাদিত পণ্য দিয়েই দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে আপদকালের জন্য খাদ্য মজুদ রাখতে হবে।’
কৃষিসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী বিএনপির কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি ২১০০ সালের মহাপরিকল্পনা নিয়েও কাজ করছি। অথচ বিএনপির নীতিই ছিল- এ দেশের মানুষ ভিক্ষা করবে। কিন্তু আমরা যুদ্ধজয়ী বীর জাতি, আমাদের কেন অন্যের কাছে হাত পাততে হবে?’
কখনও যেন বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের মানুষকে ভিক্ষার হাত পাততে না হয়, সেদিকে নজর রাখতে কৃষিবিদদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘জনগণ আমাদের ভোট দিয়েছে, আমরা ক্ষমতায় এসে জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করেছি। আগামীবার ভোট দিলেও উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যাব, আবার ভোট না দিলে নাই। কিন্তু কৃষিবিদদের নজর দিতে বলব, যেন আর কখনও এদেশের মানুষকে অন্যের কাছে ভিক্ষার হাত পাততে না হয়।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দশ বছর ক্ষমতায় ছিলাম। দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছি। তবে আমরা চাই, আমরা যে অগ্রযাত্রা শুরু করেছি তা যেন অব্যাহত থাকে। ২১০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ কেমন হবে- সেই পরিকল্পনা করে আমরা ডেল্টা প্ল্যান করেছি। সেখানে কৃষি ও পানিকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। ব্লু-ইকোনমি শক্তিশালী করা ও সমুদ্র গবেষণা কেন্দ্রও করা হয়েছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিষয়ে পড়াশোনা চালু করা হচ্ছে।’
বর্তমানে দেশের বাজারের আয়তন বেড়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘মানুষ যা উৎপাদন করে সেটাই বাজারজাত করার সুযোগ পাচ্ছে। এতে সার্বিক অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। মানুষের সচ্ছলতাও বাড়ছে। আমরা যা উৎপাদন করি তা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি।’
কৃষিক্ষেত্রে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত কাজ করা হচ্ছে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘দেশজুড়ে আমরা ভাসমান কৃষিখেত করতে পারি, ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছি। আমার এলাকায় কচুরিপানার ওপর বেড তৈরি করে মানুষকে ফসল ফলাতে দেখেছি। এরপর কৃষিমন্ত্রীকে বলেছি। সারাদেশে একই প্রক্রিয়ায় চাষাবাদ শুরু করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কিন্তু অনেকে এভাবে চাষ করতে শুরু করেছে।’
বহুমুখী ফসল চাষাবাদের ওপর গুরুত্ব দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। তিনি বলেন, ‘কখন বিপদ আপদ আসে বলা যায় না। একটা ফসলের ওপর নির্ভর করলে হবে না। তাই বিপদের সময় যাতে খাদ্য সরবরাহ করতে পারি, যেজন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি।’
তিনি জানান, সারাদেশে কয়েকটি বড় বড় সাইলো (খাদ্য সংরক্ষণাগার) তৈরি করা হয়েছে। এসব সাইলোতে ২০-২২লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ রাখতে পারব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কৃষি ও বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করার জন্য নতুন করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন নতুন বিজ্ঞানী ও গবেষক বেরিয়ে আসবে। তখন তারা এ দেশের কৃষিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
এফএইচএস/এসআর/এমএস