প্রাণ বাঁচিয়ে ফুলেল সম্মাননা পেলেন সেই চিকিৎসকরা


প্রকাশিত: ০২:২৯ পিএম, ১০ আগস্ট ২০১৫

২৩ জুলাই, আনুমানিক সন্ধ্যা তখন সাড়ে ৭টা। গুলিবিদ্ধ অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ নাজমাকে হাসপাতালে আনা হয়। চিকিৎসকরা জানতে পারেন গৃহবধূকে খুব কাছে থেকে গুলি করা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) নেয়া হয়। দ্রুত অস্ত্রোপচার করে নবজাতককে ভূমিষ্ট করান। হতবাক দৃষ্টিতে দেখতে পান মাতৃগর্ভে শিশুটিও গুলিবিদ্ধ হয়েছে।

ওই সময় মা ও নবজাতক দুজনের অবস্থায় ছিল আশঙ্কাজনক। গুলিবিদ্ধ ক্ষতস্থান থেকে অনবরত রক্ত ঝরছিল দু’জনের। জম্মের পর নবজাতকের গায়ের রং নীল হয়ে যায়। জম্মের পর নবজাতকরা কাঁদলেও সে কাঁদছিলনা। তার শ্বাস-প্রশ্বাস বলতে গেলে থেমেই ছিল। মা ও নবজাতককে প্রাণে বাঁচাতে দেয়া হয় রক্ত।
/
শিশুটির শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করতে ইনকিউবেশন করে অক্সিজেন দেয়া হয়। পরবর্তীতে ঢাকায় এনে শিশু সার্জারি বিভাগে ভর্তি করে চিকিৎসা, পরবর্তীতে নবজাতকের দেহে অস্ত্রোপচার, সংক্রমণমুক্ত রাখতে স্পেশাল বেবী কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তর করা।

সোমবার দুপুরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মাগুড়ায় মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ নবজাতক ও তার মায়ের গুলিবিদ্ধ হয়ে মাগুড়া সদর হাসপাতালে আসা ও পরবর্তীতে তাদের বাঁচিয়ে তোলার এভাবেই বর্ণনা করছিলেন মাগুড়া সদর ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চিকিৎসকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রী মা নাজমা বেগম ও নবজাতক সুরাইয়ার বেঁচে উঠার সত্যি ঘটনা শুনছিলেন।

মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ শিশু ও মায়ের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য মাগুরা সদর হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের ডেকে সম্মাননা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সোমবার মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে তাদের ডেকে ফুলেল সম্মাননা দেয়া হয়।

এ সময় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম চিকিৎসকদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, চিকিৎসকদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। ভালো কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। তাহলে চিকিৎসকরা ভালো কাজ করতে উৎসাহ পাবে। এভাবেই সমাজের বিকাশ সম্ভব।

অনুষ্ঠানের শুরুতে মন্ত্রী গুলিবিদ্ধ শিশু সূরাইয়া ও মায়ের চিকিৎসায় মাগুরা এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনেন।
/

মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ মা ও শিশুকে বাঁচিয়ে তুলতে যারা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে মাগুড়া সদর হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের কনসালটেন্ট মো. শফিউর রহমান, গাইনির ডাক্তার শামসুননাহার, শিশু বিশেষজ্ঞ জয়ন্ত কুমার কুন্ড, অর্থোপেডিকসের চিত্তরঞ্জন রায় রয়েছেন। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু সার্জারি বিভাগের এমএস থিসিস চূড়ান্ত পর্বের ছাত্র ডা. মাসুদের মাধ্যমে নবজাতকের চিকিৎসা শুরু হয়।

পরবর্তীতে সহযোগী অধ্যাপক কানিজ হাসিনা শিউলীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলতে থাকে। উন্নত চিকিৎসার জন্য পর্যায়ক্রমে একই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আশারাফুল হক কাজল, অধ্যাপক আবদুল হানিফ টাবলু, শিশু বিভাগের অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা, থোরাসিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামরুল ইসলাম, প্লাষ্টিক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক রায়হানা আউয়াল, ডা. নওয়াজেশ, চক্ষ বিভাগের ডা. ফরিদ, শিশু সার্জারি বিভাগের সহকারি রেজিস্ট্রার ডা. শিফাত, ডা. খায়রুন নাহার রুম্পা ও অ্যানেসথেসিওলজিষ্ট শফিকুল আলম যুক্ত হন। বিএসএমএমইউ নবজাতক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল মান্নানও মেডিকেল বোর্ডের সদস্য হয়ে নবজাতককে দেখে যান।

ডা. কানিজ হাসিনা শিউলী জানান, নবজাতককে বাঁচিয়ে তোলার প্রচেষ্টায় বিভিন্ন বিভাগের ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতাল (ঢামেক)-এর পরিচালক ব্রি. জে. মো. মিজানুর রহমান, নিউনেটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. আবিদ হোসেন মোল্লা, মাগুরা জেলা সিভিল সার্জন ডা. এফ বি এম আব্দুল লতিফ, মাগুরা সদর হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. মো. শফিউর রহমানসহ মোট ১৪ জনকে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়।

সম্মাননা অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্য সচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মো. নুরুল হক, বিএসএমএমইউ’র উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খানসহ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
/

গত ৪ আগস্ট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ শিশু ও তার মাকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিওনেটাল ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে যান। এ সময় তিনি বিনামূল্যে তাদের চিকিৎসার ঘোষণা দিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের সঠিকভাবে চিকিৎসা করার নির্দেশ দেন। ওই দিনই সাংবাদিকদের কাছে সুরাইয়া ও তার মাকে সুস্থ করে তোলায় চিকিৎসকদেরকে ধন্যবাদ জানান মন্ত্রী।

উল্লেখ্য, গত ২৩ জুলাই মাগুরা শহরের দোয়ারপাড় এলাকায় দুই দল সন্ত্রাসীর মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার সময় গর্ভবতী নাজমা খাতুন গুলিবিদ্ধ হন। তাকে মাগুরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ওই দিন রাতেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ শিশুটির জন্ম হয়। গুরুতর আহত শিশুটিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২৫ জুলাই ঢাকায় আনা হয়।

সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, নবজাতকের শারিরিক অবস্থা আগের তুলনায় ভালো। গতকাল তার রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় রক্ত দেয়া হয়। সে নিজেই মায়ের বুকের দুধ খেতে পারছে। তবে মা ও নবজাতককে এখনও একসঙ্গে দেয়া হয়নি।

এমইউ/আরএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।