কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দরিদ্রতা হ্রাসের পরামর্শ
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিল্প ও সেবা খাতে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে অতি দরিদ্রতা হ্রাসের পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। একই সঙ্গে অতি দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীকে সমগোত্রীয় হিসেবে না দেখে বরং ভিন্নভাবে বিবেচনায় নিয়ে তাদের দরিদ্রতা হ্রাস করতে হবে বলেও উল্লেখ করেছেন তারা।
রোববার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দারিদ্র্য বিষয়ক পরামর্শ সেমিনারে বক্তরা এসব কথা বলেন। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম।
তিনি তার মূল প্রবন্ধে বলেন, অসমতা কমিয়ে আয়বন্টন ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনাই সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। সেজন্য সেবা ও শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ কাজটি করার লক্ষ্যে যুগোপযোগি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব করা হয়েছে। আমাদেরকে উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে এক্ষেত্রে দুর্নীতি কমাতে হবে। দুর্নীতি থাকা মানেই দরিদ্রতা বেড়ে যাওয়া।
তিনি আরো বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান বাড়ায়, কর্মসংস্থান বাড়লে দরিদ্রতা কমে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাতে করে স্বল্প খরচে বিদেশ যেতে পারে তার জন্য নীতিমালা প্রণয়ণ করতে হবে। রেমিট্যান্স, ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বাড়ানো এবং তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার সর্বোত্তম করতে হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আগামী ৫ বছরে ১ কোটি ৮৭ লাখ কর্মসংস্থানের সৃষ্ঠি হবে। এ সময় চাহিদা থাকবে ১ কোটি ২৫ লাখ কর্মসংস্থানের। বাকি ৬২ লাখ কর্মসংস্থান অর্ধ-বেকারদের দিয়ে পূরণ করা হবে।
ব্র্যাকের উপদেষ্টা ড. মাহবুব হোসেন প্রবৃদ্ধি অর্জনকে প্রধান নয় বরং কোন খাতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তা জানাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বলেন, প্রবৃদ্ধি উৎপাদনশীল খাতে হলে কর্মসংস্থান তৈরি হয়ে দারিদ্র্য কমাবে। ঋণ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে মৎস্য ও পশু পালন খাতকে বিকশিত করে কৃষিখাত থেকে শিল্প ও সেবাভিত্তিক খাতে রূপান্তরিত করতে হবে। তবেই দরিদ্র্যতা কমবে।
বিশ্ব ব্যাংকের লিড ইকোনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১০ সালে সর্বশেষ খানা জরিপ করে। এরপর দারিদ্র্য নিয়ে আমরা যে তথ্য দিচ্ছি তা মূলত প্রাক্কলন। এ বছর অক্টোবরে পরিসংখ্যান ব্যুরো যখন খানা জরিপ করবে তখন তারা যেন তা বস্তুনিষ্ঠভাবে করেন।
এই অর্থনীতিবিদ অতি দরিদ্রতা কমাতে কম উৎপাদনশীল খাত থেকে বেশি উৎপাদনশীল খাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্থানান্তরের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এক ধাক্কায় দারিদ্রসীমা শতকরা ৭০ ভাগ থেকে ৪০ ভাগে নিয়ে আসা যায় কিন্তু ১০ ভাগের নিচে নিয়ে আসতে হলে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকে। তা মোকাবেলা করতে হলে বিভিন্ন ঝুঁকিকে মাথায় রেখে কর্মকৌশল ঠিক করতে হয়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক জুলফিকার আলী অতি দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীকে ভিন্ন ভিন্ন গোত্রীয় উল্লেখ করে বলেন, ফুটপাতে ঘুমানো জনগোষ্ঠী, রেললাইনের ধারে বসবাসরত মানুষ, পাহাড়ের ঢালে যারা বসবাস করছে তারা সবাই অতি দরিদ্র হলেও তাদের দরিদ্রতায় ভিন্নতা আছে। ভিন্ন ভিন্ন দরিদ্রগোষ্ঠীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নিতে হবে।
অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান দক্ষ পরিকল্পনা প্রণয়নকে কাঙ্খিত মাত্রায় উন্নয়ন না হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, আমরা অগ্রাধিকার বাছাই করার ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখাতে না পারায় আজ পর্যন্ত পিছিয়ে আছি। দরিদ্রতা দূরীকরণে বেসরকারি খাতকে সঠিক উপায়ে পূর্ণ মাত্রায় বিকশিত করতে হবে।
সেমিনারে প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে পরিকল্পনা মন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল দরিদ্রতাকে অভিশাপ আখ্যায়িত করে বলেন, আমরা কেউ দরিদ্র থাকতে চাই না। এ থেকে সমাজকে বাচাঁতে হবে। এ জন্য সম্পদকে উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ করে অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনার মাধ্যমেই দারিদ্র্য কমাতে হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রী এ সময় আরো বলেন, বর্তমান দরিদ্রসীমা ২৩ ভাগ। এটা ভালো। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি এতে খুশি নই। এ হার আরো কমা উচিত ছিল। ইন্দোনেশিয়া গত ১৬ বছরে দরিদ্রসীমা পঞ্চাশ শতাংশ কমিয়েছে। আমাদেরকেও এমন সফালতা দেখাতে হবে।
এ জন্য করণীয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে আহম মুস্তফা কামাল বলেন, সিঙ্গাপুরের জিডিপি’র ২২ শতাংশ আছে বৈদেশিক আয় থেকে। রেমিট্যান্সের মাধ্যমে আমাদের বৈদেশিক আয়ও বাড়াতে হবে।
অনুষ্ঠানে বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ এর সঞ্চালনায় সভায় সরকারের বিভিন্ন সচিব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ ও নারী নেত্রীরা অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন।
এসআই/আরএস/এমআরআই