প্রতিশোধের নেশায় চেঙ্গি নদীতে রক্তের বন্যা

আবু আজাদ
আবু আজাদ আবু আজাদ , নিজস্ব প্রতিবেদক চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ১০:৫৪ এএম, ২০ আগস্ট ২০১৮
ফাইল ছবি

রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শুরু হওয়া রক্তক্ষয়ী সংঘাত প্রতিদিনই নতুন মাত্রা পাচ্ছে। প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত সশস্ত্র পাহাড়ি সংগঠনগুলো মেতে উঠেছে খুনের বদলে খুনের খেলায়। ভাটিতে শুরু হওয়া ভ্রাতৃঘাতি এ সংঘাত এখন ছড়িয়ে পড়েছে চেঙ্গি নদীর পুরো অববাহিকা জুড়ে।

সর্বশেষ গত শনিবার (১৮ আগস্ট) সকালে চেঙ্গি নদীর উজানে চেঙ্গি ভ্যালির স্বনির্ভর এলাকায় প্রতিপক্ষের ব্রাশ ফায়ারে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ-প্রসিত) চার নেতাকর্মীসহ সাতজন নিহত হয়েছেন।

পুলিশ জানায়, শনিবার সকালে ইউপিডিএফ-প্রসিত নেতাকর্মীরা চেঙ্গি ভ্যালির স্বনির্ভর এলাকায় একটি সমাবেশকে ঘিরে জমায়েত হচ্ছিল। এ সময় অতর্কিত ব্রাশ ফায়ারে ইউপিডিএফ-প্রসিত’র তিন নেতাকর্মীসহ ছয়জন নিহত হয়। পরে এ ঘটনার প্রতিবাদে দুপুরে আরও একটি মিছিলে দুর্বৃত্তরা গুলি চালালে এক ইউপিডিএফ-প্রসিত কর্মী মারা যান।

এর আগে গত ২৮ মে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের করল্যাছড়িতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ-প্রসিত) তিন কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। দুটি ঘটনার পর পরই ইউপিডিএফ-প্রসিত সংগঠক মাইকেল চাকমা এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) দায়ী করেন।

তবে জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) তথ্য প্রচার বিভাগের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ওই হামলা ও হত্যার ঘটনা ইউপিডিএফের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের।

পাহাড়ে এ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের শুরু হয় চলতি বছরের ৩ মে। নানিয়ারচর উপজেলায় নিজ কার্যালয়ে সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) অন্যতম শীর্ষ নেতা শক্তিমান চাকমাকে।

ওই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৪ মে দুপুরে শক্তিমান চাকমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে যাওয়ার পথে সশস্ত্র হামলায় নিহত হন ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক এর শীর্ষ নেতা তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা, জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) নেতা সুজন চাকমা, সেতুলাল চাকমা, টনক চাকমা এবং গাড়ি চালক সজীব। এ সময় আহত হন আরও আটজন।

পাহাড়ে দুই আঞ্চলিক সংগঠনের বিভক্ত চার গ্রুপের সশস্ত্র ক্যাডাররা এভাবেই প্রতিশোধের নেশায় একের পর এক রক্তাক্ত ঘটনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিসেবে গত নয় মাসে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সংঘাতে অনন্ত ৩৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। নিখোঁজ হয়েছেন অন্তত ১০ জন। স্থানীয়দের দাবি, এ সংখ্যা আরও বেশি হবে। তবে এসব ঘটনায় আবারও শঙ্কা দেখা দিয়েছে পাহাড়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

পর্বত্য অঞ্চলের সচেতন মহল বলছে, গত মে মাসে ঘটা জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) নেতা শক্তিমান চাকমা ও ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক এর শীর্ষ নেতা তপন জ্যোতি চাকমা বর্মার হত্যার প্রতিশোধ নিতেই গতকালের রক্তাক্ত হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

রাঙ্গামাটির প্রবীণ সাংবাদিক সুনীল দে জাগো নিউজকে বলেন, ‘পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনীতি অনেক বেশি জটিল। এখানে কে যে কার শত্রু, কে যে কার বন্ধু তা আপনি এক কথায় বলতে পারবেন না। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকায় দলগুলো একেক সময় একেক আচরণ করে। বর্তমানে পাহাড়ে যা চলছে, তার সবটাই প্রতিশোধের রাজনীতি।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানে আঞ্চলিক গ্রুপগুলো নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে তৎপরতা চালাচ্ছে। এর সঙ্গে সামনের নির্বাচনও একটা বড় কারণ। এখনই সমাধানের উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’

ctg-4

ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের শুরু যেভাবে :

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দুই দশকের সশস্ত্র লড়াই শেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এ চুক্তি করে সরকারের সঙ্গে। তবে মূলত এ চুক্তির বিরোধিতা করেই জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের বড় একটি অংশ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ-প্রসিত) গঠন করে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে। এর নেতৃত্বে ছিলেন প্রসিত বিকাশ খীসা। দলটি গঠনের পরই জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সঙ্গে তারা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।

সংঘাত শুরুর পর থেকে রাঙামাটির প্রতিটি উপজেলা সদর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত প্রায় সব এলাকায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং খাগড়াছড়ি জেলায় ইউপিডিএফ-প্রসিত দাপট চলে আসছিল। তবে ব্যাতিক্রম ছিল রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরই উপজেলা। যেখানে গত ১৮ বছরেও পা ফেলতে পারেনি সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। রাঙ্গামাটি থেকে সড়ক পথে প্রায় বিচ্ছিন্ন উপজেলাটি যোগাযোগ ব্যবস্থায় খাগড়াছড়ির কাছাকাছি হওয়ায় এখানেও ইউপিডিএফ-প্রসিত দাপট প্রবল।

২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত নানিয়ারচরে ইউপিডিএফ-প্রসিত’র অবস্থান এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, খোদ সন্তু লারমাও কখনও ওই উপজেলায় যেতে পারেনি। এমনকি সর্বশেষ সংসদ সদস্য নির্বাচনে রাঙ্গামাটি থেকে জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) নেতা উষাতন তালুকদার নির্বাচিত হলেও নানিয়ারচর উপজেলা থেকে সামান্য কিছু ভোট পান। নানিয়ারচরে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান সবই নির্বাচিত হয়েছেন ইউপিডিএফ এর ইচ্ছায় বা ইশারায়।

মতবিরোধের জেরে ২০১০ সালে জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাতিন্দ্রলাল চাকমা পেলে, সুধাসিন্ধু খীসা ও শক্তিমান চাকমা মিলে গঠন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন-লারমা) নামে নতুন রাজনৈতিক দল। যেহেতু দলটি সন্তু লারমার কাছ থেকে সরে গিয়েই গঠিত হয়, সংগত কারণেই ইউপিডিএফ-প্রসিত সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে তাদের। এই সখ্যতার অংশ হিসেবে দুইদল একত্রিত হয়ে জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) বিপক্ষে সংঘাতে জড়ায়। জনসংহতি সমিতিও (পিসিজেএসএস) এই দুই দলকে নিজেদের শত্রু হিসেবেই তুলে ধরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে।

কিন্তু জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা) ও ইউপিডিএফ-প্রসিত এ দহরম-মহরমে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তাদের সম্পর্কে সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ২০১৬ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে।

খাগড়াছড়ি ও নানিয়ারচরে প্রবল দাপটের সঙ্গে থাকা ইউপিডিএফ-প্রসিত উপজেলা নির্বাচনে জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) বিরোধিতা ও বন্ধু গোষ্ঠীকে সুযোগ দিতে নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাচনে লড়ার সুযোগ করে দেয় জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) শীর্ষ নেতা শক্তিমান চাকমাকে। সে নির্বাচনে শক্তিমান চাকমা ইউপিডিএফ প্রার্থী সুশীল জীবন চাকমাকে পরাজিত করে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

নিজেদের ঘটিতে নিজের প্রার্থীর এই পরাজয়ে ধাক্কা কাটিয়ে উঠতেই ইউপিডিএফ-প্রসিত দেখতে পায় নিজেদের শক্ত ঘাঁটিতেই তারা পরবাসী। নিজের মেধা, যোগ্যতা আর দূরদর্শিতার কারণে শক্তিমান চাকমা নিজের দল জনসংহতি সমিতিকে (এমএনলারমা) নানিয়ারচরে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে শুরু করেন। ফলে ২০১৬ সালে নিজেদের সবচেয়ে সুরক্ষিত ঘাঁটি থেকেই উৎখাত হতে হয় ইউপিডিএফ-প্রসিতকে। এরপর থেকে পরের এক বছরে নানিয়ারচর সদরে প্রবেশ ও কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেনি ইউপিডিএফ-প্রসিত। ইউপিডিএফ-প্রসিত’র নানিয়ারচর হয়ে উঠে জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) নানিয়ারচরে। বিষয়টি কোনোভাবেই মানতে পারছিল না ইউপিডিএফ-প্রসিত। নানিয়ারচর ও খাগড়াছিড় নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে উঠে-পড়ে লাগে তারা। বিপরীতে অর্জিত অবস্থান ধরে রাখতে সচেষ্ট থাকে জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা)।

ইউপিডিএফ-প্রসিত ও জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) মধ্যে বন্ধুত্ব যখন শত্রুতায় রূপ নিচ্ছিল, তখনই পার্বত্য রাজনীতিতে ঘটে আরেক মেরুকরণ। সন্তু লারমার পর্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) চিরশত্রু প্রসিত খীসার ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট এর মধ্যে একটি বিরল রাজনৈতিক সমঝোতা হয়। ১৯৯৭ সালের পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই দুই সংগঠন পাল্টাপাল্টি হামলায় অন্তত ১ হাজার নেতাকর্মী নিহত হলেও এই বিরল সমঝোতার পর আর কোনো সংঘাত হয়নি দুই পক্ষের। এই নতুন মেরুকরণের ফলে ইউপিডিএফ-প্রসিত’র সঙ্গে তার পুরনো বন্ধু জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) দূরত্ব তৈরি হতে থাকে।

এর মধ্যে গত ১৫ ডিসেম্বর ইউপিডিএফ-প্রসিত থেকে বহিষ্কৃত ও বেরিয়ে যাওয়া নেতাকর্মীদের একটি অংশ তপন জ্যোতি চাকমা বর্মার নেতৃত্বে পৃথক ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-গনতান্ত্রিক) নামে পৃথক আরেকটি দল গঠন করে। নতুন এই দলটির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে ইউপিডিএফ-প্রসিত’র সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনে থাকা পর্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা)। ফলে পাহাড়ের রাজনীতিতে আসে নয়া মেরুকরণ।

এই মেরুকরণে ইউপিডিএফ-প্রসিত নেতাকর্মীদের ওপর শুরু হয় একের পর এক হামলা। এসব ঘটনায় পরের পাঁচ মাসে অন্তত সাতজন ইউপিডিএফ-প্রসিত নেতাকর্মী নিহত হন। এদের মধ্যে ছিলেন দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা মিঠুন চাকমাও। ফলে একদিকে নানিয়ারচরে নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণে জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) শীর্ষ নেতা শক্তিমান চাকমা চাকমার ওপর ক্ষোভ। অপরদিকে তপন জ্যোতি চাকমা বর্মার নেতৃত্বে থাকা ইউপিডিএফ-গনতান্ত্রিক কর্মীদের হাতে একের পর এক নেতাকর্মী হত্যার জন্য তপন জ্যোতি চাকমার ওপর ক্ষোভ চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় ইউপিডিএফ-প্রসিত’র।

এর মধ্যেই গত মার্চ মাসে ইউপিডিএফ এর সহযোগী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন এর দুই শীর্ষ নেত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় তপন জ্যোতি চাকমার ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক। প্রায় ৩২ দিন পর এই দুই নেত্রী মুক্তি পেলেও এই ঘটনায় তপন জ্যোতি চাকমা বর্মার উপর চরম ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে ইউপিডিএফ-প্রসিত নেতাকর্মীরা। এসব কারণে শক্তিমান চাকমা ও আর তপন জ্যোতি চাকমা হয়ে উঠে ইউপিডিএফ-প্রসিত’র মূল টার্গেট।

ctg-4

এসব ঘটনার জেরে ইউপিডিএফ-প্রসিত কর্মীদের গুলিতে চলতি বছরের ৩ মে নানিয়ারচর উপজেলায় নিজ কার্যালয়ে সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) অন্যতম শীর্ষ নেতা শক্তিমান চাকমাকে।

ওই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৪ মে দুপুরে শক্তিমান চাকমার অন্তেস্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে যাওয়ার পথে সশস্ত্র হামলায় নিহত হন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক) এর শীর্ষ নেতা তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা, জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) নেতা সুজন চাকমা, সেতুলাল চাকমা, টনক চাকমা এবং গাড়ি চালক সজীব।

এ দুটি হত্যাকাণ্ডের পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছিল শক্তিমান চাকমা ও জ্যোতি চাকমা বর্মা হত্যার প্রতিশোধ নিতে আরো হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। সেই সূত্রেই গতকাল ব্রাশ ফায়ারে ইউপিডিএফ-প্রসিত’র ৪ নেতাকর্মীসহ সাতজন নিহত হয়েছেন।

উল্লেখ্য, শক্তিমান চাকমাকে হত্যা করেও নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হতে পারেনি ইউপিডিএফ-প্রসিত। গত ২৫ জুলাই শূন্য পদে উপ-নির্বাচনের বেসরকারিভাবে নিহত শক্তিমান চাকমার জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা) সমর্থিত প্রার্থী প্রগতি চাকমা (আনারস প্রতীক) ১৪,৪৮৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইউপিডিএফ-প্রসিত সমর্থিত প্রার্থী প্রণতি চাকমা (কাপ-পিরিচ) পেয়েছেন মাত্র ৮০১৫ ভোট।

এদিকে ইউপিডিএফ-প্রসিত নেতা মিঠুন চাকমা, জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) অন্যতম শীর্ষ নেতা শক্তিমান চাকমা ও ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক শীর্ষ নেতা তপন জ্যোতি চাকমা বর্মার হত্যাকাণ্ডের জেরে খাগড়ছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে আরও বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা), ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক এবং ইউপিডিএফ-প্রসিত একে অপরকে দায়ী করছে। তবে এসব খুনের ঘটনায় প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ আর গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে বিবদমান সংগঠনগুলো।

সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর পাহাড়ের বুকে শুরু হয় আরও এক কালো অধ্যায়ের। ওই দিন নানিয়ারচর সতেরমাইল এলাকায় চিরঞ্জীব দোজরপাড়া এলাকার নিজ বাসা থেকে ডেকে নিয়ে বের গুলি করে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফ-প্রসীত সমর্থক ইউপি সদস্য অনাধি রঞ্জন চাকমাকে (৫৫)। হত্যার জন্য ইউপিডিএফ তাদেরই এক সময়ের সামরিক কমান্ডার তপন জ্যোতি চাকমা বর্মার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দায়ী করা হয়।

চলতি বছরে পাহাড়ে বিবদমান সংগঠনগুলোর আধিপত্য বিস্তারের প্রথম বলি ইউপিডিএফের (প্রসীত) সংগঠক মিঠুন চাকমা প্রকাশ জুম্মা। ৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির পানখাইয়া পাড়ার স্লুইচ গেট এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন তিনি।

২১ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সুভাষ চাকমা নামের এক ইউপিডিএফ (প্রসীত) কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে ১৭ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি শহরের হরিনাথপাড়া এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফ (প্রসীত) কর্মী দিলীপ কুমার চাকমাকে।

সপ্তাহ দুই নিরব থাকার পর ১১ মার্চ রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে নিজ বাড়িতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফ (প্রসীত) কর্মী নতুন মনি চাকমাকে। তিনি ইউপিডিএফের প্রসীত বিকাশ খীসা পক্ষের কর্মী ছিলেন। একদিন পর ১৮ মার্চ রাঙ্গামাটির কুতুছড়ি থেকে অপহরণ করা হয় ইউপিডিএফ (প্রসীত) সমর্থিত হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমাকে।

ইউপিডিএফ এ ঘটনার জন্য সংগঠন থেকে বেরিয়ে গিয়ে পৃথক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দায়ী করে। তবে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) বরাবরই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিল।

ctg-4

এ ঘটনার রেশ ধরে ১২ এপ্রিল পাল্টাপাল্টি হামলায় নিহত হয় তিনজন। রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় ইউপিডিএফ-প্রসীত কর্মী জনি তঞ্চঙ্গ্যাকে (৪০) গুলি করে হত্যার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) দুই কর্মী সাধন চাকমা (৩০) ও কালোময় চাকমাকে (২৯) গুলি করে হত্যা করা হয়।

তিনদিন পর ১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ি শহরের পেরাছড়া এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় সূর্য বিকাশ চাকমা নামে একজন নিহত হয়। তিনিও ইউপিডিএফ-এর দুই অংশের বিরোধের কারণে মারা গেছেন বলে ধারণা করা হয়। ওই ঘটনার এ সপ্তাহের মাথায় ২২ এপ্রিল খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার মরাটিলা এলাকায় ইউপিডিএফ ও জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় সুনীল বিকাশ ত্রিপুরা (৪০) নামের এক ইউপিডিএফ-প্রসীত)- নেতা নিহত হন।

ইউপিডিএফ নেতা সুনীল বিকাশ ত্রিপুরা কাতাং খুনের এক মাসের মাথায় ২২ মে দীঘিনালার গুলছড়ি রাখাল মহাজনপাড়ার তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে উজ্জ্বল কান্তি চাকমা ওরফে মার্শাল (৫০) নামে ইউপিডিএফ-প্রসীত এর এক কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষ।

ইউপিডিএফ কর্মী খুনের দুই মাসের মাথায় ১৬ জুন পানছড়িতে বিজয় কুমার ত্রিপুরা নামে জনসংহতি সমিতির (এমএনলারমা) এক সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহত বিজয় কুমার ত্রিপুরা পানছড়ির পাইয়ংপাড়ার বাসিন্দা। অভিযোগ রয়েছে নিজের টিলা ভূমিতে কাজ করার সময় স্বশস্ত্র ইউপিডিএফ-প্রসীত সমর্থকরা তাকে ব্রাশ ফায়ার করে পালিয়ে যায়।

কদিন বিরতির পর ১২ জুলাই খাগড়াছড়িতে জ্ঞানেন্দু চাকমা (৪০) নামে প্রসীত বিকাশ খীসা সমর্থিত ইউপিডিএফের এক কর্মীকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। এ ঘটনার মাত্র তিন দিনের মাথায় ১৫ জুলাই প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা) সমর্থিত মাটিরাঙ্গা উপজেলা যুব সমিতির সভাপতি শান্তি জীবন চাকমা (৪০)।

খাগড়াছড়ির সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুল আওয়াল জাগো নিউজকে বলেন, ‘পাহাড়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন সবসময় সচেতন রয়েছে। পাহাড়ি সংগঠন গুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জন্য এসব ঘটনা ঘটছে। এমনকি ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ বক্সেও হামলার ঘটনা ঘটেছে।’

রাঙামাটির পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘খাগড়াছড়ির ঘটনার রেশ ধরে যাতে রাঙামাটিতে কিছু ঘটতে না পারে সেলক্ষ্যে আমরা পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ টহল জোরদার করেছি। গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পোশাকি সদস্যদের উপস্থিতি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে।’

তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তৈয়ব চৌধুরী মনে করেন, ‘পাহাড়ের সমস্যা রাজনৈতিক আধিপত্যের। মূল ধারার রাজনীবিদরা কম মনোযোগ দেন বলেই সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। এখনই পাহাড়কে অস্ত্র মুক্ত করা না গেলে, বড় দলগুলোও এই সন্ত্রাস থেকে নিজেদের বেশিদিন বাঁচাতে পারবে না।’

এমবিআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।