বিআরটিএ-তে লাইসেন্স-ফিটনেস সনদ আবেদনের হিড়িক
শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক তৈরির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অফিসে ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরি ও ফিটনেস সনদ আবেদনের হিড়িক পড়েছে। তবে লাইসেন্স প্রত্যাশীদের পদে পদে বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। অন্যদিকে, দৌরাত্ম্য বেড়েছে দালাল চক্রের। সোমবার বিআরটিএ সার্কেল-১ কার্যালয়, মিরপুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, গাড়ির কাগজপত্র তৈরি করতে বিআরটিএ’র এলাকাজুড়ে প্রধান সড়কগুলোতে লম্বা লাইন। অনেকে ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করে বিআরটিএ অফিসে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। এদিন এক মিনিটের জন্যও প্রবেশপথের যানজট কমেনি। প্রবেশপথে দায়িত্বরত আনসার বাহিনীর সদস্যরা যানজট দূর করতে হিমশিম খান। গাড়ি আর মানুষের বাড়তি চাপে ভেতরে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। ভেতরে গাড়ির লাইসেন্সের জন্য ফর্ম নিতে লম্বা লাইন তৈরি হয়েছে। এ লাইন ভবনের বাইরে পর্যন্ত চলে যায়।
কর্মকর্তারা বলছেন, ড্রাইভিং লাইসেন্সের সরকারি ফি ৩ হাজার ৫০০ টাকা। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে ছয়-সাত মাস সময় লাগে। শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স করার ছয় মাস পর ব্যবহারিক পরীক্ষার তারিখ দেয়া হয়। আগে যেখানে সারা দিনে দুইশর মতো গাড়ির লাইসেন্স নবায়ন ফর্ম বিক্রি হতো, এখন সেই সংখ্যা চারগুণ বেড়ে গেছে। লাইসেন্স পাবার কাউন্টারেও উপচেপড়া ভিড়। তবে, সবচাইতে বড় ভোগান্তি লাইসেন্স ফি জমা নেয়া ব্যাংক কাউন্টারে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকে টাকা জমা দিতে পারেনি। গাড়ির লাইসেন্স পাওয়ার অপেক্ষায় তাই কড়া রোদের মধ্যেই ঘণ্টার ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। ব্যাংক জামার চারটি লাইন তৈরি হয়েছে। প্রতিটি লাইনে সহস্রাধিক মানুষকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
যাত্রাবাড়ী থেকে গাড়ির লাইসেন্স নবায়ন করতে এসেছেন রাকিবুল ইসলাম। সকাল ১০টায় ব্যাংকে নবায়ন ফি জমা দিতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। বেলা ২টা বাজলেও ২০ জনের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। জাগো নিউজকে বলেন, লাইসেন্স নবায়ন করতে সকালে এসেছি। এখন দুপুর হয়ে গেছে, এখনও ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে রশিদ নিতে পারিনি। গতকাল রোববার এসে লম্বা লাইন দেখে ফিরে গেছি। তাই আজ সকাল সকাল এলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
মোহাম্মদপুর থেকে এসেছেন মুজাহিদ খান। গত তিন মাস আগে বাইক কিনলেও এখনও ড্রাইভিং লাইসেন্স করেননি। বর্তমানে ট্রাফিক আইন কড়াকড়ি হওয়ায় ঝামেলা এড়াতে তিনি এসেছেন লাইসেন্স করতে। কিন্তু দিন পার হয়ে গেলেও ব্যাংকের লাইন শেষ হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি। তার মতো দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত ভুক্তভোগীরা অনলাইন বা অন্যকোন মাধ্যমে সব ফি প্রদান সুবিধা তৈরির দাবি জানান।
গত এক বছর আগে বাইক কিনেছেন পুলিশ কর্মকর্তা ইমদাদ আলী। এতদিন ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া চালিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঝামেলায় না পড়তে এসেছেন ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরি করতে। লাইসেন্স গ্রহণ শাখায় দাঁড়ানো ইমদাদ বলেন, লাইসেন্স করব করব করেও ব্যস্ততার কারণে করা হয়নি। আজকে এসেছি লাইসেন্স নিতে।
অন্যদিকে, মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের মূল ফটকের বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দালাল চক্র। কার্যালয়ের ভেতরে বিভিন্ন কক্ষের আশপাশে, ব্যাংকে, বাদামতলায় সর্বত্র দালালেরা তৎপর। মূল ফটকের পাশে স্ট্যাম্প, ফটোকপির দোকানগুলো তাদের মূল আস্তানা।
বেলা আড়াইটা পর্যন্ত সেখানে থেকে দেখা গেল, দালালদের হাতে দিলে দ্রুত কাজ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি ব্যাংকে ফি জমা দেয়ার ক্ষেত্রেও দালালদের অগ্রাধিকার। সাধারণ সেবাগ্রহীতা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন। সেবা নিতে আসা লোকজন অভিযোগ করেন, সাধারণ প্রক্রিয়ায় সেবা পেতে অযথা হয়রানি করা হচ্ছে। অথচ দালালদের দিয়ে দ্রুত কাজ হয়ে যাচ্ছে। আনসার বাহিনীর কাছ থেকে জানা গেছে, প্রতিদিন সাত-আটজন দালাল ধরছেন তারা। অনেকে দালালের খপ্পরে পরে সর্বশান্ত হয়ে ফিরছেন।
বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (লাইসেন্স) মোহাম্মদ আলী আহমেদ মিলন জাগো নিউজকে বলেন, গত পাঁচদিনে এই কার্যালয়ে নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য প্রায় একশ মতো আবেদন জমা পড়েছে। আর নবায়নে প্রায় দেড় হাজার আবেদন জমা পড়ছে। গড়ে প্রতিদিন নতুন ২২০টি আবেদন আসছে, যা আগে প্রতিদিন ১০০টির মতো আবেদন হতো। আর লাইসেন্স নবায়নের জন্য প্রতিদিন প্রায় ৩০০টি আবেদন জামা হতো, আগে এ আবেদন ছিল ১০০ থেকে ১২০টি মতো। লাইসেন্স-সংক্রান্ত কার্যক্রম গড়ে আড়াই গুণ বেড়েছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে লাইসেন্স ছাড়া রাস্তায় গাড়ি চালাতে নানা ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। ট্রাফিক আইন পরিবর্তন হচ্ছে, কড়াকড়ি হয়েছে আইন। এসব কারণে নতুন লাইসেন্স তৈরি ও নবায়নকারীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। বেড়েছে আবেদনের সংখ্যাও।
বিআরটিতে এসে অনেকেকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে এ অভিযোগ শিকার করে উপ-পরিচালক বলেন, সেবা প্রত্যাশীদের বড় ভোগান্তির জায়গা হচ্ছে ব্যাংকে টাকা জামা দিয়ে রশিদ সংগ্রহ করা। এজন্য দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। দ্রুতই ভোগান্তি কমাতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এমএইচএম/জেএইচ/এমএস