শ্রদ্ধাঞ্জলি : অনিরুদ্ধ সাংবাদিক, লেখক সন্তোষ গুপ্ত
বরেণ্য সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও বিট্রিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী-মুক্তিযোদ্ধা, স্বর্গীয় সন্তোষ গুপ্তের এগারোতম মৃত্যুবার্ষিকী ৬ আগস্ট। ২০০৪ সালের এই দিনে তিনি লোকান্তরিত হন । ১৯২৫ সালের ৯ আগস্ট তাঁর জন্মগ্রহণ। পিতা যোগেশ চন্দ্রগুপ্ত ও মা কিরণবালা গুপ্তা। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান সন্তোষ গুপ্ত জীবদ্দশাতেই আজীবন সংগ্রামী ও আপোসহীন এক কীর্তিমান পুরুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাফল্য অর্জন করেন।
সেদিন কে জানত, ঝালকাঠি জেলার কীর্তিপাশা গ্রামের পিকে ইনস্টিটিউটের হ্যাংলা-পাতলা ও দীর্ঘদেহী সেই কিশোর সন্তোষই একদিন সাংবাদিকতা করে আর শাসকদের শোষণ-নিপীড়নের প্রতিবাদ জানিয়ে দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন করবে।
১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পাস করে সন্তোষ গুপ্ত কলকাতা যান উচ্চশিক্ষা নিতে। ভর্তি হন সেখানকার সিটি কলেজে। কিন্তু তরুণ সন্তোষের সারাক্ষণ পড়ালেখা নিয়ে বসে থাকতে মন চাইত না। দেশজুড়ে তখন চলছে ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন। ঝাঁপিয়ে পড়লেন এই সংগ্রামে। ইতোমধ্যে ১৯৪৪ সালে ২৭ বছর বয়সে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে নিজেকে অনাগত জীবনের সংগ্রামী যোদ্ধা হিসাবে প্রস্তুত করে তোলেন।
সন্তোষ গুপ্ত তাঁর দীর্ঘ জীবনে সবচেয়ে বেশি বিচলিত হন ১৯৪৬ সালে। কলকাতায় তখন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছিল। হিন্দু সন্তোষ গুপ্ত সেদিন আক্রান্ত মুসলমানদের রক্ষা করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাঙ্গা বিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তার এক বছর পর, ১৯৪৭ সাল। ভাগ হয়ে গেল দেশ। হিন্দুদের সঙ্গে আর কলকাতায় থাকলেন না সন্তোষ গুপ্ত। ফিরে এলেন ঢাকায়।
এ প্রসঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু কথাশিল্পী শওকত ওসমান লিখেছেন, “ হিন্দু সন্তোষ গুপ্ত হিন্দুর দেশে থাকলেন না। ফিরে এলেন মুসলমানের দেশে, তাঁর জন্মভূমিতে।” সাম্রাজ্যবাদী বিট্রিশরাজ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য ১৯৪৫, ১৯৫৪ ও ১৯৫৮ সালে পর পর তিনবার সন্তোষ গুপ্ত দীর্ঘ কারাভোগ করেন।
পেশাজীবনে পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও সরকারি চাকুরি তিনি করতে পারেননি। রাজনৈতিক কমিটমেন্ট তাকে সরকারি আজ্ঞাবহের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসে স্বাধীন পেশা সাংবাদিকতায়। ১৯৫৭ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন সন্তোষ গুপ্ত এবং মৃত্যুর পূর্ব পযর্ন্ত সংবাদেই ছিলেন। তবে মাঝখানে কিছুদিন দৈনিক আজাদে কাজ করেন। ১৯৭১ সালে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মুজিবনগর সরকারের তথ্য বিভাগে সহকারী সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
সন্তোষ গুপ্তের লেখার বিষয় রাজনীতি, সমাজনীতি, মানবাধিকার, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, গণমাধ্যম ও শিল্পকলাসহ বহুবিধ ক্ষেত্রে বিস্তৃত। বিট্রিশ-পাকিস্তান-বাংলাদেশের সব আমলেই সরকারি নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়ে জনমানুষের মধ্যে তিনি আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে, যে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন তিনি, সেই দেশের স্থপতি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেও তিনি সরকারি নিপীড়নের শিকার হন।
জীবদ্দশায় প্রকাশিত সন্তোষ গুপ্তের কয়েকটি উলেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে, ‘অনুত্তম বক্তব্য’ (১৯৮৭), ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে’ (১৯৯৬), ‘ইতিহাসের ছায়াচ্ছন্ন প্রহর ও বঙ্গবন্ধু’ (১৯৯৬), ‘ইতিহাস আমাদের দিকে’ (১৯৯৭), ‘বাংলাদেশের চিত্রশিল্প: স্বরূপের সন্ধান’ (১৯৯৭), ‘অসমাপ্ত কবিতা’ (১৯৯৯), ‘শিল্প, সমাজ ও বাস্তবতা’ (১৯৯৯), ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বনাম সাংবাদিকতা’ (২০০০) ও ‘বেগম সুফিয়া কামাল স্মারকগ্রন্থ’সহ (সম্পাদিত ২০০১) ‘একুশের চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ’, ‘সমাজতন্ত্রের অন্য ইতিহাস’ এবং ‘কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস স্মারকগ্রন্থ’ (সম্পাদিত)। তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই প্রকাশিত হয়েছে ‘সন্তোষ গুপ্ত স্মারকগ্রন্থ’।
সন্তোষ গুপ্তের দীর্ঘজীবনের কর্মধারায় এই যে এতসব প্রতিবাদী চেতনা আর সংগ্রামী ভূমিকার যে দৃষ্টান্ত আমরা লক্ষ করি, তার অধিকাংশই ফুটে উঠেছিল তাঁর দৈনিক সংবাদ পত্রিকার অনিরুদ্ধ ছদ্মনামে লিখিত কলামগুলোতে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই অনিরুদ্ধকে কেউ কখনও উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে শোনেনি।
১৯৮৮ সালে এক দুর্ঘটনায় জ্যেষ্ঠপুত্র পঙ্কজ গুপ্ত মিন্টু যমুনা নদীতে নিখোঁজ হন, সেদিনও সন্তোষ গুপ্ত উচ্চৈঃস্বরে কাঁদেন নি। কাউকে জোরে ধমক দেয়া দূরে থাক, চিরশত্রুকেও তিনি কঠিন কণ্ঠে সতর্ক করতেন না। খুবই নিন্মস্বরে কথা বলতেন সন্তোষ গুপ্ত।
একেবারেই সাদামাটা জীবন ছিল তাঁর। আমৃত্যু তিনি এই বৈশিষ্ট্যে অক্ষুণ্ণ ছিলেন। তাঁর এগারোতম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
এইচআর/এমআরআই