স্বস্তি ফিরলেও কাটেনি শঙ্কা

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:৩১ পিএম, ৩০ জুন ২০১৮

জঙ্গিবাদে গোটা বিশ্ব যখন টালমাটাল তখন স্বস্তির বাতাস মিলছে বাংলাদেশে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে ভেঙে তছনছ ‘জঙ্গি ডেরা’। অভিযানের পর অভিযান। শহর থেকে গ্রামে, সর্বত্রই জঙ্গিবিরোধী হানা। র‌্যাব-পুলিশের চলমান অভিযানকে বাংলাদেশের জন্য বড় সাফল্য হিসেবেই দেখছেন বিশিষ্টজনরা।

বিশেষ করে গুলশানের হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলার পর থেকে দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে তৎপরতা দেখিয়েছে, তা অনেকেই প্রশংসার চোখে মূল্যায়ন করছেন। অভিযানের পাশাপাশি জঙ্গি ইস্যুতে জনমতকে অনেকাংশেই ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ধর্ম, রাজনীতির বেড়াজালেও যে জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়া যায় না- এমন শিক্ষা এখন মানুষ গণমাধ্যম থেকেও পাচ্ছেন। জঙ্গিবাদকে ‘না’- এ আহ্বানে সাড়া মিলছে সব মহল থেকেই।

তবে জঙ্গি দমনে এমন সফলতার পরও শঙ্কা কাটেনি- এমনটি মনে করছেন কেউ কেউ। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু অভিযান পরিচালনা করে জঙ্গি বা চরমপন্থা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। অভিযানে সাময়িক স্বস্তি মিলতে পারে, কিন্তু আদর্শকে আদর্শ দিয়ে মোকাবেলা করা না গেলে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে জঙ্গিরা।

জঙ্গিবাদবিরোধী অবস্থান নিয়ে লিখছেন, গবেষণা করছেন সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক শাহরিয়ার কবির। জঙ্গিবাদের বিস্তার ও দমন নিয়ে তিনি বলেন, ‘গুলশানের হলি আর্টিসানে হামলার পর পুলিশ, র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে ভূমিকা রাখছে, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। সরকারের কঠোর অবস্থানে গত দুই বছরে আর কোনো বড় ধরনের জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেনি। সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এমন সফলতার প্রশংসা করছেন আন্তর্জাতিক মহলও।’

তবে সরকারের নীতির সমালোচনা করে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘চলমান অভিযানের কারণে জঙ্গিরা হয়তো গা ঢাকা দিয়েছেন। ‘জঙ্গি নির্মূল হয়েছে’ এমন আত্মতৃপ্তি নিয়ে বসে থাকলে মহাবিপদ আসন্ন। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা মূলে যেতে চাই না। এদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার কেন এবং কীভাবে ঘটছে এটি উপলব্ধি করতে না পারলে, শুধু অভিযানে সমাধান আসবে না।’

ধর্ম এবং ধর্মীয় রাজনীতির নামে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটছে- উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের আমল থেকেই জঙ্গিবাদের সূত্রপাত। এরপর যারাই ক্ষমতায় এসেছেন তারাই ধর্মের ওপর ভর করে রাজনীতি করছেন। বর্তমান সরকার যখন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে বসেন, তখন জঙ্গি দমনের অভিযান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কারণ এই হেফাজতরাই জঙ্গিবাদের গডফাদার।’

তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ একটি ধর্মকে পৃষ্ঠপোষণ করলে জঙ্গিবাদ বিশেষ বৈধতা পায়। রাষ্ট্রে এখন তাই চলছে।’

‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সফল অভিযানের কারণেই জঙ্গি দমন হয়েছে এবং স্বস্তি ফিরে এসেছে’- মনে করেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, নতুনদের যখন রেডিকালাইজড করা হয় তখন তাদের বলা হয় সরকার সংশ্লিষ্ট ১০ ভাগ মানুষ বাদে দেশের ৯০% মানুষ কথিত এই জিহাদ সমর্থন করে। কিন্তু হলি আর্টিসানের ঘটনা এবং ওই ঘটনার পর চলমান অভিযানে সবাই বুঝতে পারছেন, সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, যারা এ ধরনের কাজে লিপ্ত হয়েছেন তাদের পরিবারও সমর্থন করেন না। অভিযানে নিহত জঙ্গিদের ডেড বডিও গ্রহণ করেননি তাদের পরিবার। প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন। ফলে যারা রেডিকালাইজড ছিল, তারা আর জঙ্গিবাদে যোগদান করেননি। তারা বুঝেছেন, এই দেশের মানুষ জঙ্গিবাদকে গ্রহণ করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না। ফলশ্রুতিতে নব্য জেএমবিতে রিক্রুটমেন্ট হয়নি। অনেকেই জঙ্গিবাদে নতুন নাম লিখিয়েছিল, তারাও ফিরে আসেন। অনেক ফ্যামিলি যোগাযোগ করেছে আমাদের সঙ্গে। তাদের ছেলে-মেয়েকে ফিরিয়ে এনেছি। নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় সফলতা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন অবশ্য মনে করেন, জঙ্গি ইস্যু রীতিমতো গবেষণার বিষয়। তিনি বলেন, ‘সমাজে চরমপন্থা আগে থেকেই ছিল। বামপন্থী, ডানপন্থীদের মধ্যে চরমপন্থার নীতি আগেও ছিল। তার মানে সমাজ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এমন সুযোগ করে দিচ্ছে। পরিবার, সমাজ ভেঙে যাওয়ার পেছনে রাষ্ট্রের যে দায় আছে, তা তো অস্বীকার করার সুযোগ নেই।’

তিনি বলেন, ‘গুলশানের ঘটনা সব পরিষ্কার করে দিয়েছে। এর দায় সবার। দেশ অন্ধকারে গেলে কেউ রক্ষা পাবে না। আজকের যে পরিস্থিতি তার দায় তো সরকারের উপরেই বেশি। তবে গত দু’বছরে পুলিশের অভিযানে বিশেষ সফলতা এসেছে, যা অবশ্যই স্বস্তির বলে মনে করি।’

পুলিশের সাবেক আইজিপি এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক নুরুল হুদাও জঙ্গি দমনের চলমান অভিযানের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গি দমনে ভূমিকা বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। দীর্ঘমেয়াদে আমরা কতটুকু সফলতা অর্জন করতে পারব, তা এখন ভাবনার বিষয়।’

তিনি বলেন, ‘সমাজ, রাজনীতি ও মানুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা না করলে যে কোনো অঘটনই ঘটতে পারে। এই প্রশ্নে রাষ্ট্র কতটুকু প্রস্তুত তাই মূলত দেখার বিষয়।’

একই বিষয়ে স্বস্তির পাশাপাশি উদ্বেগ প্রকাশ করেন সমাজচিন্তক, সাবেক মন্ত্রী ড. মীজানূর রহমান শেলী। তিনি বলেন, ‘আমরা কোথায় আছি এবং কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে তার প্রমাণ দিয়েছে হলি আর্টিসান হত্যাকাণ্ড। এই ক্ষত হাজারও বিপদের জানান দেয়। গেল দুই বছরে দেশে বড় ধরনের কোনো জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেনি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও প্রশংসনীয়। কিন্তু একটি আদর্শ তো আসলে বন্দুকের গুলি দিয়ে দমিয়ে রাখা যায় না। অস্থির রাজনীতি, বৈষম্যমূলক অর্থনীতি, সমাজনীতির কারণে যে কোনো সময়ে চরমপন্থার উদ্ভব ঘটতে পারে। এ কারণেই জঙ্গি নিয়ে কথা বলতে হলে আমাদের গোড়ায় যেতে হবে।’

এএসএস/এমএআর/এমআরএম/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।