অবশেষে বন্ধই হয়ে গেল ইস্টার্ন কেমিক্যাল
যুদ্ধাহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের কল্যাণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মালিকানাধীন চট্টগ্রামের ইস্টার্ন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
লোকসানের কথা জানিয়ে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার চার দশকের পুরনো এই প্রতিষ্ঠানটিতে শনিবারের (৩০ জুন) পর থেকে লে-অফ ঘোষণা করা হয়েছে। গত ২১ জুন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ও উপ-ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হারুন স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশের মাধ্যমে একথা জানানো হয়।
শ্রমিকদের অভিযোগ, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কারসাজি করেই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিয়েছেন। বেসরকারিভাবে লিজ দিয়ে এক সময়ের লাভজনক এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটির জমিতে কন্টেইনার ডিপো করার চেষ্টা চালাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এদিকে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণার খবরে স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
ইস্টার্ন কেমিক্যালের উপ-ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হারুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত এক দশক ধরেই প্রতিষ্ঠানটি লোকসানি শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত। এটি লাভজনক করতে বেশ কিছু উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল। তারপরও প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনক করতে পারেনি। তাই ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষের বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের আলোকে উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরই মধ্যে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্নিষ্ট সবাইকে অবহিত করা হয়েছে। শনিবার (৩০ জুন) থেকেই প্রতিষ্ঠানর সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে।’
তবে ইস্টার্ন কেমিক্যালের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ট্রাস্টের অন্যান্য শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভর্তুকি দিয়ে চালানো হলেও ইস্টার্ন কেমিক্যালে কখনো ভর্তুকি দেয়নি ট্রাস্ট। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের শীর্ষ পর্যায়ের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজসে ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় ইস্টার্ন কেমিক্যালের মালিকানাধীন চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের দুটি প্লটে বহুতল ভবন নির্মাণ ও রাঙ্গুনিয়ার কারখানা ও পাহাড়ি জমিতে কন্টেইনার ডিপো তৈরির সুপারিশ করা হয়।
এটিকে পুঁজি করে ট্রাস্টের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা কারখানাটিকে লিজ দিতে উঠেপড়ে লাগে। সেসময় লিজের খবরে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিলে সাবেক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ইস্টার্ন কেমিক্যাল চালু রাখার উদ্যোগ নেন। সে যাত্রায় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা পেলেও গত দেড় বছরে সেখানে কর্মরত স্থায়ী শ্রমিকদের কৌশলে ট্রাস্টের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বদলি করে দেন। শুধু অস্থায়ী শ্রমিকদের রেখে গত দেড় বছর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চালানো হয়। সর্বশেষ আদেশে আজকের (৩০ জুন) পর থেকে ইস্টার্ন কেমিক্যাল লে-অফ ঘোষণা করা হয়।
সূত্রটি আরও জানায়, বন্ধ হতে যাওয়া ইস্টার্ন কেমিক্যালের রয়েছে আড়াই কোটি টাকার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল। সর্বশেষ এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে চারজন কর্মকর্তা, ২৪ জন কর্মচারী ও ১২ জন শ্রমিকসহ মোট ৪০ জন কর্মরত আছেন। এছাড়া অস্থায়ী শ্রমিক কাজ করেন আরও ৪০–৫০ জন। সব মিলিয়ে কর্মকর্তা ও শ্রমিক কর্মচারীদের মাসিক বেতন বাবদ ব্যয় হয় সাড়ে আট লাখ টাকা। অথচ ২০১৭ সালেও গড়ে কারখানায় মাসিক উৎপাদিত মালামাল বিক্রিয় করে পাওয়া গেছে ২২ লাখ টাকার বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতির জনকের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের পেছনে লোকসান নয়, কাজ করছে অন্যকিছু। রাঙ্গুনিয়ার ১০ একর জমিতে ইস্টার্ন কেমিক্যালে বিশাল স্থাপনা থাকলেও এই শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক ও ডেপুটি চিফ অ্যাকাউন্টেনসহ কর্তাব্যক্তিরা অফিস করেন চট্টগ্রাম নগরের মোহরা শিল্প এলাকায় ট্রাস্টের অপর বন্ধ প্রতিষ্ঠান মাল্টিপল জুস কনসেনট্রেট প্ল্যান্টের অফিসে।
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ঢাকা কেন্দ্রীয় সিবিএর সভাপতি মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ইস্টার্ন কেমিক্যাল ট্রাস্টের লাভজনক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম একটি। ২০১৫ সালেও এটি লাভজনক ছিল। অথচ ২০১৬ সালের এপ্রিলে কয়েক মাসের লোকসান দেখিয়ে সেটি এখন বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই এটি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।’
১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের বাওয়ানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠিত রাঙুনিয়ার ইস্টার্ন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে এটিকে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। এর আগে রাঙ্গুনিয়ার কর্ণফুলী জুট মিল ও ফোরাত-কর্ণফুলী কার্পেট মিলস বন্ধ ঘোষণার পর শিল্পাঞ্চলটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।
এমবিআর/পিআর