গাজীপুর সিটি নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে : ইডব্লিউজি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:০৯ পিএম, ২৮ জুন ২০১৮

 

গত ২৬ জুন অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ কেন্দ্রে ১৫৯টি অনিয়মের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি)। আর এসব অনিয়মের বেশিরভাগই দুপুরের পর সংঘটিত হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষণে উঠে আসা গুরুত্বপূর্ণ অনিয়মের মধ্যে রয়েছে- জোর করে ব্যালট পেপারে সিল মারা, ভোটকেন্দ্রের ৪০০ গজের ভেতরে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো এবং ভোটকেন্দ্রের ভেতরে অননুমোদিত ব্যক্তির অবস্থান।

এছাড়া পর্যবেক্ষণ কার ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোট প্রদানের গড় হার ৬১ দশমিক ৯ শতাংশ বলে জানিয়েছে ইডাব্লিউজি।

বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ বিষয়ে প্রাথমিক বিবৃতি জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় বেসরকারি এই সংস্থাটি।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ইডব্লিউজির পরিচালক ড. মো আব্দুল আলীম, সদস্য আব্দুল আওয়াল, ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ও হারুনুর রশিদ।

সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক বিবৃতি পড়ে শোনান ইডব্লিউজির পরিচালক ড. মো আব্দুল আলীম। সেখানে জানানো হয়, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জোরদার করার লক্ষ্যে ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশের ২৮টি প্রতিষ্ঠিত সিভিল সোসাইটি প্রতিষ্ঠানের-সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত হয় ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতীয় সংসদ, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ, নির্বাচন-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে অ্যাডভোকেসি, নির্বাচনী ব্যবস্থারর অধিকতর উন্নয়নে মতামত প্রদান করে আসছে ইডব্লিউজি।

সংবাদ সম্মেলনে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ বিষয়ে জানানো হয়, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সর্বমোট ৪২৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ইডব্লিউজি ৫৭টি ওয়ার্ডেরই ১২৯টি (৩০ শতাংশ) ভোট কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছে। ইডব্লিউজির এই ব্যাপক ভিত্তিক পর্যবেক্ষণে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয় সেগুলো হলো- ভোট কেন্দ্র খোলার সময়কাল পর্যবেক্ষণ, ভোটগ্রহণ কার্যক্রম, ভোটকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা ও গনণা এবং ভোটকেন্দ্রের বাইরের সার্বিক পরিস্থিতি।

ভোটগ্রহণ শুরুর সময় :

ইডব্লিউজির নিয়োগকৃত পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বেশিরভাগ (৯৮ শতাংশ) ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রস্তুত ছিল এবং নির্ধারিত সময়েই ভোটগ্রহণের জন্য ভোটকেন্দ্র উন্মুক্ত করা হয়েছিল। ভোটগ্রহণ শুরুর আগে ব্যালট বাক্সগুলো যে খালি ছিল সেটা প্রমাণের জন্য পর্যবেক্ষণ করা সকল ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট ও পর্যবেক্ষকদের সামনে ব্যালট বাক্স খোলা হয়েছিল। পর্যবেক্ষণ করা সকল ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরুর সময় ভোটাদের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ কেন্দ্রে ১ থেকে ২০ জন ভোটার, ২০ দশমিক ২ শতাংশ কেন্দ্রে ২০ থেকে ৪০ জন ভোটার এবং ৪০ দশমিক ৩ শতাংশ কেন্দ্রে ৪০ জনেরও বেশি ভোটারের লাইন পরিলক্ষিত হয়েছে। ভোটগ্রহণের সময়ে ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষকরা ৯৬ দশমিক ৯ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট এবং ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে বিএনপি মেয়র প্রার্থীর এজেন্টদের দেখতে পেয়েছেন।

EWG-1

ভোটগ্রহণ কার্যক্রম :

ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্রের (৮১ দশমিক ৪ শতাংশ) কক্ষগুলো যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে প্রস্তুত করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণ করা ৯৪ দশমিক ৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী, বয়স্ক এবং গর্ভবতী নারী ভোটারদের ভোট প্রদানের জন্য অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছিল। ৯৫ দশমিক ৩ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে ভোটের গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল এবং পর্যবেক্ষণ করা ভোটকেন্দ্রগুলোতে গড়ে নয়জন নারী পোলিং অফিসারকে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছিল। সকল ভোটকেন্দ্রেই পোলিং এজেন্টদের দেখতে পেয়েছেন। যদিও পর্যবেক্ষণ করা কেন্দ্রের সকল ভোটকক্ষে সব প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের দেখা যায়নি। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে গড়ে ১১ জন নারী পোলিং এজেন্টকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।

ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষকরা বেলা ৩টায় পর্যবেক্ষণ করা সকল ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে কোনো অভিযোগ বা আপত্তি করা হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে তারা জানান- ওই সময় পর্যন্ত মোট ১৬টি অভিযোগ বা আপত্তি তাদের কাছে এসেছে।

পর্যবেক্ষণ করা কেন্দ্রে দিনের বিভিন্ন সময়ে ভোট প্রদানের হার লিপিবদ্ধ করেছেন তারা। সেখানে সকাল ১০টায় ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ, দুপুর ১টায় ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ বিকেল ৩টায় ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং বিকেল ৪টায় ৬১ দশমিক ৯ শতাংশ।

নির্বাচনী অনিয়ম :

ভোটগ্রহণ শুরু থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষকরা ৪৫ শতাংশ (৬০টি ভোটকেন্দ্র) ভোটকেন্দ্রে সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী অনিয়মের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে- জোর করে ব্যালট পেপারে সিল মারা, ভোটকেন্দ্রের ৪০০ গজের ভেতরে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো এবং ভোটকেন্দ্রের ভিতরে অননুমোদিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি।

অনিয়মের কারণে পর্যবেক্ষণকৃত ১২টি ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়, এর মধ্যে ৯টি কেন্দ্র ভোটগ্রহণ পুনরায় চালু করা হয়।ইডব্লিউজি পর্যবেক্ষণ করা ভোটকেন্দ্রে সর্বমোট ১৫৯টি নির্বাচনী অনিয়িমের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন। এগুলোর মধ্যে আছে ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেখা হয়নি ৬টি। ভোটারকে ভোটকক্ষে প্রবেশের পর আঙুলে কালির ছাপ দিয়ে বলা হয়েছে আপনার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। এমন ঘটনার সংখ্যা ৩টি। পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়ার ঘটনা ৩টি, পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ৬টি, ভোটকেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা হয়েছে ২৮টি, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে প্রার্থী কর্তৃক যানবাহন সরবরাহ করার ঘটনা ২৪টি, কেন্দ্রে অননুমোদিত ব্যক্তির উপস্থিতি দেখা গেছে ৩০টি, ভোটকেন্দ্রের ভেতরে সহিংসতা ঘটেছে ৮টি, ভোটকেন্দ্রের বাইরে সহিংসতা ৯টি, অবৈধভাবে ব্যালট পেপারে সিল মারা হয়েছে ২১টি, আইনশৃংখলা বাহিনী বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এমন ঘটনা ৫টি, অন্যান্য ১৬টি সর্বমোট মোট ১৫৯টি।

৩২ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে বেলা ১১টার দিকে পাঁচজন ভোটারকে ভোট প্রদানের সময় মেয়ের প্রার্থীর ব্যালট পেপার প্রদান করা হয়নি। প্রায় একই সময়ে বিএনপির পোলিং এজেন্টদেরও ওই কেন্দ্রে থেকে বের করে দেয়া হয়। বেলা ১টার দিকে ওই একই কেন্দ্রে ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষক দেখতে পান- ব্যালট পেপারে অবৈধভাবে সিল মারা হচ্ছে এবং দায়িত্বরত আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা একজন মেয়র প্রার্থীর সরবরাহ করা খাবার গ্রহণ করেছে।

দুপুরের দিকে ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের একই কেন্দ্রে ইডব্লিউজির একজন পর্যবেক্ষকে ভোটকেন্দ্রের এক কোনায় চলে যেতে বলা হয়। পর্যবেক্ষক একটু পাশে সরে যেতেই তিনি দেখতে পান ওই কেন্দ্রের ৪টি ভোটকক্ষে উপস্থিতি সংশ্লিষ্ট ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তারা ব্যালট পেপার নিয়ে তাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ফেলছেন।

বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ৫০ নং ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষক কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের ব্যালট পেপারে সিল মারার কাজে নিয়োজিত থাকতে দেখেন। বেলা ৪টার দিকে ওই একই কেন্দ্রে ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষক আবারও অবৈধভাবে ব্যালট পেপারে সিল মারার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন।

২০ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে দেখা যায় বেশ কিছু সংখ্যক অননুমোদিত ব্যক্তি সারাদিন ধরে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ঘোরাঘুরি করছে। বিভিন্ন সময় তাদেরকে প্রিজাইডিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে।

ভোটগ্রহণ সমাপ্তি ও গণনা :

ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বেশিরভাগ কেন্দ্র (৯৪ দশমিক ৮ শতাংশ) নির্ধারিত সময় অনুযায়ী বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হয়। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরপরই পর্যবেক্ষণ করা সকল কেন্দ্রে ভোট গণনা শুরু হয়েছিল। পর্যবেক্ষণ কারা ১২৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৮৮টি কেন্দ্রের গণনা পর্যবেক্ষণ করে ইডব্লিউজি। গণনার পূর্বে সকল ব্যালট বাক্সে নিরাপত্তা সিল সঠিকভাবে লাগানো ছিল। গণনার সময় ইডব্লিউজির পর্যবেক্ষকরা দেখতে পান ভোটাগ্রহণকারী কর্মকর্তারা ফলাফল শিটে একজন মেয়র প্রার্থীর পক্ষে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা বাড়িয়ে লেখেন, ওই সময় গণনা কক্ষে বিএনপি প্রার্থীর কোনো এজেন্ট উপস্থিত ছিলেন না।

 

এএস/এমবিআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।