দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে ট্রাইব্যুনাল গঠনের তাগিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:২২ পিএম, ০৯ জুন ২০১৮

‘যেখানে মাদক, সেখানে অবৈধ টাকা ও অস্ত্র থাকে। সেখানে অভিযান চালাতে গেলে ফায়ারিং তো হবেই’- এমন মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। শনিবার রাজধানীর বিআইআইএসএস (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ) অডিটোরিয়ামে ‘মাদকবিরোধী অভিযান ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এ মন্তব্য করেন।

আলোচনায় সমাজের বিভিন্ন পেশার বক্তারা চলমান মাদকবিরোধী অভিযান ও বন্দুকযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অভিযান শুরুর পর অনেকে আমাকে ফোন করে প্রশংসা করেছেন। একজন স্ত্রী তার স্বামীকে ক্রসফায়ারে দেয়ার আহ্বানও জানান। তবে এ অভিযানে শুধু যে বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে তা নয়। আমাদের কারাগারের ধারণক্ষমতা ৩৫ হাজার। বর্তমানে সেখানে ৮৬ হাজার ৩৩৯ বন্দী রয়েছেন, যার ৩৯% মাদকের সঙ্গে জড়িত। অভিযানে অনেককে গ্রেফতার করে মামলা ও সাজা দেয়া হচ্ছে।

‘কাউকে হত্যার উদ্দেশ্য নয়, বিএনপিকে কোণঠাসা করাও উদ্দেশ্য নয়; দেশ, মেধা ও তরুণ সমাজকে বাঁচাতে এই অভিযান’- মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সভায় উপস্থিত মেজর (অব.) মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীরা মানুষ নয়, তাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। আমি মাদকবিরোধী এ অভিযানকে (বন্দুকযুদ্ধ) স্বাগত জানাই। বাংলাদেশে যাকেই জিজ্ঞাসা করেন, সেই বলছে অভিযান ভালো হচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ীদের ধরলে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী পাওয়া যায় না, কেউ সাহায্য করে না, তাহলে তাদের বিচার কীভাবে হবে?’

‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আমার একটাই অনুরোধ, যে সব পুলিশ এ অভিযানগুলো পরিচালনা করছেন সরকার যেন তাদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।’

সংসদ সদস্য নূরজাহান বেগম মুক্তা বলেন, ‘এ সরকার গলায় কিছু রাখে না, সবসময় ঝেড়ে কাশি দেয়। মাদক ব্যবসায়ী সংসদের ভেতরে-বাইরে যেখানেই থাকুক তাকে ধরা হবেই। এর দৃষ্টান্ত আপনারা ইতোমধ্যে দেখেছেন। টাঙ্গাইলের রানা ও লতিফ সিদ্দিকী সংসদ সদস্য হয়েও বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, রাঘববোয়াল থেকে শুরু করে চুনোপুঁটি সবাই আইনের আওতায় আসবে।’

ইয়াবার আমদানি রুখতে নাফ নদে মাছ ধরা বন্ধের পরামর্শ দেন তিনি। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আসামি যখন পুলিশকে মারে পুলিশ তখন কী করবে, পুলিশ তো দেশের নাগরিক, তাদেরও তো বাঁচাতে হবে।’

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. এম এনামুল হক বলেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদের সমাধান ভাবতে হবে। প্রয়োজনে সময় নিন, ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করুন। একতরফাভাবে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা না ঘটিয়ে তাদের সুযোগ দিতে হবে। দেশে আইনের অভাব নেই, কিন্তু এর প্রয়োগও নেই। শুধু অভিযান চালালেই হবে না, মূল্যায়ন করতে হবে অভিযান কেমন হলো।’

বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক মেহতাব খানম বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে ঘর থেকে সচেতনতা শুরু করতে হবে। আমাদের পিতা-মাতাদের শিক্ষিত হতে হবে। একজন সন্তানকে জন্ম দেয়ার আগে তাদের সন্তান লালনপালনের জ্ঞান নেয়া উচিত। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আনতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মাদক সমাজের বড় ব্যাধি হলেও ভবিষ্যতে ইন্টারনেট আসক্তি আরও ভয়াবহ হবে। একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব বয়সী মানুষ প্রতি সাত মিনিট পরপর একবার মোবাইল ব্যবহার করছেন, যা উদ্বেগজনক। ইন্টারনেট হোক কিংবা মাদক, যে কোনোটি দমনের ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিকারের বিষয়টি চিন্তা করতে হবে। গুটি কয়েক মানুষ মেরে মাদকের সমস্যার সমাধান হবে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমানে অনেক শিশু পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হচ্ছে, কারণ তাদের ব্যস্ত রাখা হচ্ছে না। তাদের স্কুলে নানা ধরনের কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিজে ব্যস্ত রাখতে হবে। মাদক নিয়াময়ে দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করতে হবে। এছাড়া অনেক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে অনিয়ম হচ্ছে, সেগুলোতে সরকারি নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে।’

‘আমরা দেখেছি, জেলখানার মধ্যেও মাদকের সেবন হচ্ছে, সেগুলো বন্ধ করতে হবে। সর্বোপরি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভালো শিক্ষক দিতে হবে।’

দৈনিক আমাদের অর্থনীতির সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, “আমাদের সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ আছে যাদের কোনো কাজ নেই। কথায় আছে, ‘আইডিয়াল মাইন্ড ডেভিলস ওয়ার্কশপ।’ সমাজের নিম্নবিত্তরা কাজ পাচ্ছে না, উচ্চবিত্তরা কাজ করছে না। ফলাফল একই, তারা ব্যস্ত থাকছে না, ফলে মাদক গ্রহণ করছে। তাদের ব্যস্ত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।”

বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য সরদার সাখাওয়াত হোসেন বুলবুল বলেন, ‘টেকনাফের সংসদ সদস্য বদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বললেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তার বিরুদ্ধে কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। আমি জানতে চাই, টেকনাফের কাউন্সিলর একরামকে হত্যা করা হলো। একরামের বিরুদ্ধে মন্ত্রীর কাছে কী প্রমাণ আছে? প্রধানমন্ত্রীও তার সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই অভিযান চলছে। তাহলে একরামের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য দেখাতে পারেননি কেন?’

সম্প্রতি মাদকবিরোধী অভিযানে আওয়ামী লীগের এক নেতার বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমার অনুরোধ, আপনাদের এ অভিযান নিয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী রাজনৈতিক কথা বলছেন (এবার বিএনপির নেশাখোরদের ধরা হবে)। এগুলো বলা থেকে তাদের বিরত রাখবেন। সবাইকে কমেন্ট করতে দিয়েন না।’

‘অভিযান সম্পর্কে বলতে চাই, ক্রসফায়ারে প্রতিকার হচ্ছে না। মাদকের চাহিদা ও জোগান বন্ধ করতে হবে।’

আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বলেন, “আগে মাদকের মামলায় নিম্ন আদালতে জামিন না পেয়ে সবাই সুপ্রিম কোর্টে আসত। সেখান থেকে জামিন নিয়ে যেত। একটা কোর্টই ছিল যেটার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘মাদকের কোর্ট’। আমি অবাক হই মাদকের সাড়ে চার হাজার মামলা পেন্ডিং কিন্তু এটার বিচারের জন্য আলাদা কোর্ট নেই। অথচ স্বামী-স্ত্রীর বিবাদ মেটাতে পরিচালিত হয় ১০টা কোর্ট। মাদকের মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল ও আলাদা কোর্টের ব্যবস্থা করা দরকার।”

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমান সরকারের এ অভিযান একটি ভুল পদক্ষেপ। কোনো মতেই বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করা উচিত নয়। ইয়াবা বন্ধ করা না করা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে। উনি চাইলেই বন্ধ করতে পারবেন। উনি যদি বর্ডারে সত্যিকারের ভালো লোক বসাতে পারেন তাহলেই বন্ধ করা সম্ভব।

‘শুধু ইয়াবা নয় বাংলাদেশে যেসব এনার্জি ড্রিংক রয়েছে, সেগুলোও বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি এনার্জি ড্রিংকে অ্যালকোহল রয়েছে। এটাকে বন্ধ না করে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে লাভ নাই।’

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, ‘অভিযান নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো অনেক কথা বলেন। অথচ মাদকাসক্তরা নিজেরাও ধ্বংস হয়, তাদের সঙ্গে একটি পরিবারও ধ্বংস হয়। আমি অনেক পরিবার দেখেছি যারা মাদকাসক্তের কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন মানবাধিকার কমিশন কোথায় থাকে?’

‘আমি এ অভিযানের পক্ষে। যারা মাদক দিয়ে সমাজকে ধ্বংস করছে তাদের গুলি করতে হবে। এ অভিযান থেকে পিছপা হলে জাতিকে অনেক পিছিয়ে যেতে হবে।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে বাসে পোশাক শ্রমিক রূপাকে যারা ধর্ষণ করেছিল তারাও মাদকাসক্ত ছিল। যদি ওই ধর্ষকদের রিমান্ডে এনে বন্দুকযুদ্ধ দিতেন সমাজের সবাই খুশি হতো।’

এ সময় তিনি ভারতীয় সিরিয়াল ও রাত ১২টার পর ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধেরও পরামর্শ দেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘মাদকের আগ্রাসন তৃণমূলে পৌঁছে গেছে। গত বছর সব বাহিনীর অভিযানে চার কোটি ইয়াবা উদ্ধার হয়েছিল। এ বছর তিন মাসে দুই কোটি ৬০ লাখ ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। অভিযান সত্যেও ইয়াবা কমছিল না। এখন আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়েছি। যারা মাদক ব্যবসা করে এবং এখন গা ঢাকা দিয়েছে, তাদের আমরা যত বেশি অস্থির রাখতে পারব অভিযান তত বেশি সফল হবে।’

একজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত মাদক ব্যবসার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মাদক সঙ্গে না পেলে আইন কাউকে ধরতে সাপোর্ট করে না। আইনের সংস্কার চলছে। নতুন আইনে মাদকের পেছনের ব্যক্তিরাও শাস্তির আওতায় আসবে।’

তিনি আরও বলেন, “নতুন আইনে সীসা’কেও মাদক হিসেবে ধরা হবে। ইতোমধ্যে দেশের জেলখানাগুলোতে মাদক নিরাময়কেন্দ্র করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনটি কারাগারে ইতোমধ্যে কেন্দ্র করা হয়েছে। সবদিক থেকেই মাদক বন্ধে আমরা বদ্ধপরিকর।”

মাদকের সঙ্গে অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তিনি বলেন, “মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ১২ জন কর্মকর্তার ডোপ টেস্ট করা হয়েছে। সবার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। মাদক উদ্ধার করেও সেগুলো ‘উদ্ধার না দেখানোর কারণে’ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। ৭০ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।”

এআর/এমএআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।