নববর্ষে যৌন হয়রানি : ঢাবির ৮ দফা সুপারিশ হাইকোর্টে


প্রকাশিত: ১১:৩৬ এএম, ০১ আগস্ট ২০১৫

নববর্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যৌন হয়রানির ভিডিও চিত্র দেখে দোষীদের গ্রেফতার করা উচিত বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে সুপারিশ করা হয়েছে। সম্প্রতি ঢাবির পক্ষ থেকে হাইকোর্টে জমা দেয়া প্রতিবেদনের ৮ দফা সুপারিশে এ কথা বলা হয়।

গত ৩০ জুন হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে ওই প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের জমা দেওয়া প্রতিবেদনের ওপর ২ আগস্ট রোববার পরবর্তী আদেশ দেবে বলে ঠিক করেন আদালত। ওইদিন শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আইনজীবী এএফএম মেসবাহ উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য নাসরিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে নারীদের ওপর যৌন হয়রানির ঘটনায় হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য নাসরিন আহমেদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটির প্রতিবেদনে পহেলা বৈশাখে ঘটা যৌন হয়রানি ও ভবিষ্যতে এ ধরনের হয়রানিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ৮ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। জাগো নিউজকে এ কথা জানিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবী এএফএম মেসবাহ উদ্দিন।

তিনি জানান, প্রতিবেদনের প্রথম দফায় সুপারিশ করা হয়- পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণে নারীদের ওপর যারা যৌন হয়রানি করেছে, ভিডিওচিত্র দেখে তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়নি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। ভিডিওচিত্র দেখে দোষীদের গ্রেফতার করা কোনো কঠিন কাজ ছিল না। অথচ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তবুও দোষীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিৎ পুলিশের বিভাগের কাজের গতি বাড়াতে সরকারের প্রতি দাবি জোরালো করা।

দ্বিতীয়ত, আগামী বছর পহেলা বৈশাখ নির্বিঘ্নে করার জন্য সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমন্বয়ে ‘উদযাপন কমিটি’ গঠন করতে হবে।

তৃতীয়ত, বর্ষবরণের দিন ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা রমনা ও সোহরাওয়ার্দী এলাকায় ব্যাপক মাত্রায় পুলিশ সদস্যের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রশিক্ষিত সদস্যের সমন্বয়ে ‘ঝটিকা বাহিনী’ গঠন করতে হবে। এই বাহিনী শাহবাগ থানায় অবস্থান নিতে পারে। সেখান থেকে তারা যেকোনো স্থানে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঝটিকা অভিযান চালাতে পারে।

চতুর্থত, পহেলা বৈশাখের আগের দিন থেকে বর্ষবরণ এলাকায় বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দোকান বা বিভিন্ন কোম্পানির পণ্যসামগ্রীর বিজ্ঞাপনের গাড়ি প্রবেশ বন্ধ করে দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই বর্ষবরণের দিন দোকানপাট বা পসরা বসাতে অনুমতি দেওয়া যাবে না।

পঞ্চমত, সুপারিশে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বা সহকারী প্রক্টররা পহেলা বৈশাখের দিন পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবেন। যাতে কোনো সমস্যা হলে তড়িৎপদক্ষেপ নিতে পারেন।

ষষ্ঠত, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য সংখ্যা বাড়াতে হবে।

সপ্তম, পহেলা বৈশাখ উদযাপন সুশৃঙ্খল করতে বিভিন্ন ছাত্র-সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে বলে সুপারিশে বলা হয়েছে।

সবশেষ অষ্টম সুপারিশে বলা হয়েছে, সার্বজনীন অনুষ্ঠান পহেলা বৈশাখকে কলুষিত বা প্রশ্নবিদ্ধ করতে একটি বিশেষ গোষ্ঠী যেন রাজনৈতিক ফায়দা নিতে না পারে সেজন্য আমাদের সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে।

সুপারিশ প্রণয়নের ব্যাপারে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রইউনিয়নের সভাপতি, প্রক্টর, রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ ও নিরাপত্তাকর্মী, শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে সব মানুষের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান ‘পহেলা বৈশাখ’। এত বড় অনুষ্ঠানে ঢাকার রমনা জোনের নতুন একজন উপ-পুলিশ কমিশনারকে দায়িত্বে রাখা নির্বুদ্ধিতার সামিল।

নববর্ষের দিন প্রক্টর আমজাদ আলী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ক্যাম্পাসে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সন্ধ্যার আগে-পরে তিনি মোবাইল ফোনে কর্তব্যরত অন্যদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

ঘটনার দিন একদল ‘বিকারগ্রস্ত’ লোক জঘন্য যৌনহয়রানির কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় বর্ষবরণের দিন যে ঘটনা ঘটেছে, তা কমিটির কাছে ‘সত্য বলে প্রতীয়মান’ হয়েছে। এজন্য ভবিষ্যতে ‘বিকারগ্রস্ত’দের সামাল দেওয়ার জন্য সমাজের সব স্তরের লোকদের এগিয়ে আসতে হবে। পহেলা বৈশাখ উদযাপনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আলাদা কোনো কমিটি গঠন করেনি। ঘটনার দিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৯টি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা ছিল। এর মধ্যে পঞ্চম ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিওচিত্র দেখে ঘটনা বা অভিযুক্তদের শনাক্ত করা যায়।

টিএসসির পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করতে মানুষের জটলা বেশি ছিল। সেই তুলনায় সেখানে পুলিশ ছিল না। টিএসসিতে রাজু ভাস্কর্যের পাশে পরিস্থিতির অবণতি ঘটলে মাত্র ২ জন পুলিশ মৃদু লাটিচার্জ করে। ঘটনা আঁচ করতে পেরে সন্ধ্যার দিকে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়। যৌন উদ্রেককারী একজনকে আটক করলেও পরে তাকে ছেড়ে দেন পুলিশ সদস্য সাইদুল হক ভূঁইয়া। এছাড়া কাউকে আটক বা গ্রেফতার করে নিকটস্থ শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়নি। বর্ষবরণের আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এক বৈঠক হয়। বৈঠকে পহেলা বৈশাখ পালনের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বেশকিছু পরামর্শ বা দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশ তা পালন করেনি বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।

বর্ষবরণের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একদল সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর সদস্যরা নারীদের লাঞ্ছনা করে। এ ঘটনায় পত্রিকায় বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনগুলো বিবেচনায় নিয়ে গত ১৬ এপ্রিল হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নির্দেশসহ রুল জারি করেন। পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ঘটনা তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। এরই ধারবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু পুলিশের মহাপরিদর্শক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কি না, তা জানা যায়নি। বিষয়টিতে পুনরায় আদেশ দেওয়ার জন্য ৭ জুলাই হাইকোর্টের কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

এফএইচ/এসএইচএস/একে/এমআরআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।