সাকার মৃত্যুদণ্ড বহাল
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর চূড়ান্ত রায়েও মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ বুধবার এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার কার্যালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ৯টি সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয় প্রসিকিউশন। এর মধ্যে ৩, ৫, ৬ ও ৮ নং অভিযোগের প্রতিটিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড. ২, ৪ ও ৭নং অভিযোগের প্রতিটিতে তাকে ২০ বছর করে জেল এবং ১৭ ও ১৮ নং অভিযোগে তাকে ৫ বছর করে জেল দিয়ে রায় ঘোষণা করেছে ট্রাইব্যুনাল-১। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের রায়ে আজ ৭ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয় আপিল বিভাগ। এ অভিযোগে রয়েছে রাউজানের সতীশ চন্দ্র পালিতকে হত্যার দায়। এ অভিযোগে তাকে ট্রাইব্যুনালের রায়ে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। আর বাকী ৮ টি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে দেয়া রায় বহাল রাখা হয়।
যে চারটি হত্যা-গণহত্যার দায়ে সাকাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো ৩ নম্বর অভিযোগ-অধ্যক্ষ নুতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, ৫-নম্বর অভিযোগ-রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে তিনজনকে গণহত্যা, ৬ নম্বর অভিযোগ-রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় ৫০ জনেরও বেশী লোককে গণহত্যা এবং ৮ নম্বর অভিযোগ- চট্রগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে হত্যার অভিযোগে। ২-নম্বর অভিযোগ রাউজানের গহিরা গ্রামের হিন্দুপাড়ায় গণহত্যা এবং ৪ নম্বর অভিযোগ জগৎমল্লপাড়ায় ৩২ জনকে গণহত্যার অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়াও ১৭ নম্বর অভিযোগ- মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ করে নির্যাতন এবং ১৮ নম্বর অভিযোগে চান্দগাঁওয়ের সালেহউদ্দিনকে অপহরণ করে সাকা চৌধুরীর পারিবারিক বাসভবন গুডসহিলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
বিভিন্ন মন্তব্যের কারণে বিতর্কিত সাকা চৌধুরী। তিনিই প্রথম বিএনপি নেতা, যার মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় হল। সাকা চৌধুরী হচ্ছেন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করা দ্বিতীয় ব্যক্তি, মানবতাবিরোধী অপরাধে চূড়ান্ত রায়েও যার সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের রায় হল।
মৃত্যুদণ্ড দিয়ে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায় বিষয়ে আনা আপিলের ওপর গত ৭ জুলাই শুনানি শেষে আজ ২৯ জুলাই রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য করা হয়েছিল। এ নিয়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে আপিল বিভাগে আসা পঞ্চম আপিল মামলার শুনানি চূড়ান্ত রায় হল।
সাকা চৌধুরীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট এএসএম শাহজাহান ও খন্দকার মাহবুব হোসেন। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। গত ৫ থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত তিন কার্যদিবসে সাকা চৌধুরীর পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এসএম শাহজাহান। এর আগে প্রথমে আসামিপক্ষে গত ১৬ জুন শুনানি শুরু করে ৮ কার্যদিবস ট্রাইব্যুনালে দেয়া রায়, সাক্ষীদের সাক্ষ্য-জেরা এবং রায় সংক্রান্ত অন্যান্য নথিপত্র (পেপারবুক) উপস্থাপন করেন আইনজীবী এসএম শাহজাহান। এরপর গত ৩০ জুন এবং ১ ও ৭ জুলাই তিন কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে সাকা চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালে দেয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ন্যায় ও অতি প্রয়োজন ছিল। রায়ে সে প্রত্যাশা পূরন হয়েছে। তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় সাকা চৌধুরী পাকিস্তানি বাহিনী ও নিজস্ব বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে। একই দিনে চার স্থানে পর্যন্ত তাণ্ডব চালানো হয়েছিল। ১৯৭১এর এপ্রিল থেকে জুলাই পযর্ন্ত এসব অপরাধ হয়েছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ওপর বেশি হামলা করা হয়। যেন তারা দেশ ছেড়ে চলে যান। এসব অপরাধের চারটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল এ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দিয়েছে। মৃত্যুদণ্ডের এ রায় বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায় বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেনি। আপিলে আসামিপক্ষের শুনানির বিপরিতে রায় বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে আমরা আর্জি পেশ করেছি। আজ রায়ে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে হিন্দু ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক নিধনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হলো। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে ছিলেন না বলে তার পক্ষে আনা দাবীও রায়ে নাকচ হলো।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, নিয়ম অনুযায়ী আপিলের এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর তা ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। সেটি হাতে পেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে ট্রাইব্যুনাল। তবে পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবে আসামিপক্ষ। সেক্ষেত্রে তখন রায় কার্যকর রিভিউ নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকবে।
অন্যদিকে আসামির আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন আজ রায় পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, তারা এই রায়ে সন্তুষ্ট নন। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেলে রিভিউ আবেদন করা হবে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার পর পরই গত ১৬ জুন শুরু হয় আপিল বিভাগে আসা ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে পঞ্চম আপিলের শুনানি। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড রায়ের বিরুদ্ধে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিল আবেদনটি আপিল বিভাগে পঞ্চম আপিল মামলা। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নাল আবেদীন ২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর এ আপিল দায়ের করেন।
২০১৩ সালের ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল ১ এর তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল সাকা চৌধুরীকে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ২৩টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়।
হরতালে গাড়ী পোড়ানো ও ভাংচুরের এক মামলায় সাকা চৌধুরীকে ২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাতে গ্রেফতার করা হয়। তদন্তের স্বার্থে এক আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। সে থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
এর আগে আরো ৪টি মামলা সুপ্রিমকোর্টে আপিলে নিস্পত্তি হয়েছে। আপিলের প্রথম রায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার আপিল নিষ্পত্তির পর ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয় আপিল বিভাগ। এর রায় রিভিউ এর আবেদনও খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ। এরপর ওই বছর ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর আপিলের দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ট্রাইব্যুনালে দেয়া সাজা মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ। আপিলের তৃতীয় রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ট্রাইব্যুনালে দেয়া ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়। ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখার রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামানের রিভিউ (পুর্নবিবেচনা) আবেদনও খারিজ করে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। গত ১১ এপ্রিল শনিবার রাতে এ ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের মধ্যে কামারুজ্জামান হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি যার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হলো।
গত ১৬ জুন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপিলের চূড়ান্ত রায়েও মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেয় আপিল বিভাগ। এখন মজাহিদের মামলায় আপিলের পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
এফএইচ/এআরএস