খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু

ফজলুল হক শাওন
ফজলুল হক শাওন ফজলুল হক শাওন , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৯:০৬ এএম, ১৭ মার্চ ২০১৮

গোপালগঞ্জের অজো পাড়া গাঁ টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া এক শিশু। নাম তার খোকা। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ এই শিশুটির। শিশু থেকে দুরন্ত কৈশর। মধুমতি নদীতে সাঁতার কেটে টগবগে যুবকে পরিণত হয় সেই শিশুটি। কালক্রমে এই খোকা হয়ে ওঠেন বাংলার মহানায়ক। তিনি আর কেউ নন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু। তিনি জাতির পিতা। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম নেয়া শিশুটি খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পিছনে যে ইতিহাস সেটার পিছনে মূখ্য ভূমিকা রেখেছে তার অদম্য নেতৃত্ব আর ত্যাগ।

স্বনামধন্য লেখক আহমদ ছফা তার শেখ মুজিবুর রহমান নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ, একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিত পূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে।’

তার পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান, মাতা সায়েরা খাতুন। তিনি পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান। পরিবারের সবাই ‘খোকা’ নামে ডাকতেন। কেউ কি ভেবেছিল শেখ পরিবারের আদরের ছোট্ট খোকা একদিন বিশ্বনন্দিত নেতা হবেন কিংবা স্বাধীনতায় নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ত্রাণকর্তা? গভীর দেশপ্রেম, সীমাহীন আত্মত্যাগ ও অতুলনীয় নেতৃত্বে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তার বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্বে একটি দেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলার শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে নেতৃত্বের জন্য জনগণ তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে তার সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, জেল-জুলুম, নির্যাতন-কারাবন্দির কারণে ইতিহাসে তাকে জাতির পিতার অভিধায় অভিষিক্ত করা হয়।

মার্চ মাস একটি ঐতিহাসিক মাস। এই মাসেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। এই মাসেই তিনি জাতিকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এই মাসেই তিনি নিজেদের একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর বক্তব্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করা ছিল সুচিন্তিত এবং সমাজ সেবামূলক। স্কুলের ছাত্রত্বকালীন সময়ে তিনি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠিয়ে গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার খরচ বহন করা, বস্ত্রহীন পথচারী শিশুকে নিজের নতুন জামা পরিয়ে দিতেও তিনি কার্পণ্য করতেন না। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের দায়িত্ব নেয়ার মতো মহৎ গুণ শক্তভাবেই ধারণ করেছিলেন সেই শৈশবেই।

১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে সারাদেশে এক ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু বলেন, “দিন রাত রিলিফের কাজ করে কুল পাই না। লেখাপড়া মোটেই করি না। কলকতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। আব্বা একদিন আমাকে ডেকে বললেন। ‘বাবা রাজনীতি কর, আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছো, এতো সুখের কথা। তবে লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবা না। আরেকটা কথা মনে রেখ- sincerity of purpose and honesty of purpose থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না’। আব্বার একথা কোনদিন আমি ভুলি নাই”।

পিতা শেখ লুৎফুর রহমানের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা ‘দায়িত্বশীলতা’ ও ‘দেশপ্রেম’ এই দুটি শব্দকে বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত করেছেন পুরো জীবনে। পরাধীন দেশকে ও দিশাহীন জাতিকে লক্ষ্যস্থীর করতে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রশংসার দাবিদার।

অসীম সাহসিকতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ভয় পেতেন না বঙ্গবন্ধু। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি বলেন, “ছাত্রলীগের বাৎসরিক সম্মেলন হবে ঠিক হল। বহুদিন সম্মেলন হয় না। কলকাতায় আমার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল- বিশেষ করে ইসলামিয়া কলেজে কেউ আমার বিরুদ্ধে কিছুই করতে সাহস পেত না। আমি সমানভাবে মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগে কাজ করতাম। এই সময় একদিন শহীদ সাহেবের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়। তিনি আনোয়ার সাহেবকে একটা পদ দিতে বলেন, আমি বললাম, কখনোই তা হতে পারে না। সে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোটারি করেছে, ভাল কর্মীদের জায়গা দেয় না। কোনো হিসাব-নিকাশও কোনোদিন দাখিল করে না। শহীদ সাহেব আমাকে হঠাৎ বলে বসলেন, who are you? you are nobody. আমি জবাবে বললাম - If I am nobody, then why you have invited me? you have no right to insult me. I will prove that I am somebody. Thank you sir. I will never come to you again একথা বলে চিৎকার করতে করতে বৈঠক ছেড়ে বের হয়ে এলাম”।

১৯৩৯ সালের কথা। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ মিশনারি স্কুল পরিদর্শনে আসেন। তার সঙ্গে ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক, স্কুল পরিচালনা পর্ষদ সবাই ব্যস্ত। দু’সপ্তাহ আগেই ছাত্র-ছাত্রীদের বলে দেয়া হয়েছে সেদিন যেন সকলে পরিস্কার-পরিছন্ন মার্জিত পোশাক পড়ে স্কুলে হাজির হয়। স্কুল পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী মহোদয় ডাকবাংলোর দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এমন সময় একদল ছাত্র এসে হঠাৎ তাদের পথ আগলে দাঁড়ালো। ছাত্রদের এমন কাণ্ড দেখে হেডমাস্টার সাহেব রীতিমত ভড়কে গেলেন।

তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘এই তোমরা কী করছ রাস্তা ছেড়ে দাও।’ এমন সময় হ্যাংলা পাতলা লম্বা ছিপছিপে মাথায় ঘন কালো চুল ব্যাক ব্রাশ করা খোকা (বঙ্গবন্ধু) একেবারে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে দাঁড়ালেন। মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি চাও?’ বুকে সাহস নিয়ে নির্ভয়ে খোকা উত্তর দিলেন, ‘আমরা এই স্কুলেরই ছাত্র। স্কুলের ছাদে ফাটল ধরেছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই সেখান থেকে বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে আমাদের বই-খাতা ভিজে যায়। ক্লাস করতে অসুবিধা হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার এ ব্যাপারে বলা হলেও কোনো ফল হয়নি। ছাদ সংস্কারের আর্থিক সাহায্য না দিলে রাস্তা মুক্ত করা হবে না। কিশোর ছাত্রের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব , সৎ সাহস আর স্পষ্টবাদীতায় মুগ্ধ হয়ে মূখ্যমন্ত্রী বলতে বাধ্য হলেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা যাও। আমি তোমাদের ছাদ সংস্কারের ব্যবস্থা করছি। তিনি অবিলম্বে ছাদ সংস্কারের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিলেন। এ ঘটনার সময় বঙ্গবন্ধু মাত্র অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। (সূত্র- অসমাপ্ত আত্মজীবনী)

বঙ্গবন্ধু বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রতিটি বাঙালির কাছে পৌঁছে দিয়েছেন পরাধীনতার শিকল ভাঙার মন্ত্র। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও পরে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এর ভিতর দিয়ে তিনি আবির্ভুত হলেন বাঙালি জাতির মহানায়ক বা শীর্ষ নেতা হিসেবে।

শেখ মুজিবুর রহমানকে তার কাছের সবাই ডাকতেন মুজিব ভাই বলে। এ নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন বন্ধু, নেতা, কর্মী সবার কাছে। ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবরণ করেন তিনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাবার পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের এক বিশাল জনসভায় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। সেদিন থেকে তিনি আর শেখ মুজিব বা নেতা-কর্মীদের মুজিব ভাই নন। বাঙালির প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু।

একটি মানুষ সংগঠনের জন্য এতো ত্যাগ স্বীকার করতে পারে সেটা ভাবাই যায় না। বঙ্গবন্ধুর বাবা তাকে বলেছিলেন তিনি চাইলে বিলেতে গিয়ে লেখাপড়া করতে পারবেন। কিন্তু তিনি যাননি। ১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রিত্ব ছেড়ে সংগঠনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সত্তরের নির্বাচনের আগেই বঙ্গবন্ধু লন্ডনে বসে মুক্তিযুদ্ধের সব প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে কিন্তু ক্ষমতা দেবে না পকিস্তানি শাসকরা। প্রবাসীদের সহায়তায় লন্ডনে বসেই সশস্ত্র যুদ্ধের সব কৌশল ও পরিকল্পনা করেন। সবাইকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তত থাকতে নির্দেশ দেন। নির্বাচনের পরে ঠিক তাই হলো।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, বাঙালি জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। এদিন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার আহ্বান জানান। এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” একটানা নয় মাস চলে যুদ্ধ। নয় মাসের যুদ্ধের পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন জাতির জনক। এরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর দেশকে পূনর্গঠনে তিনি মনোনিবেশ করেন।

মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অন্যান্য আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি বার বার জেল খেটেছেন। ফাঁসির মঞ্চে নিয়েও তাকে মারতে পারেনি পাকিস্তানিরা। বাঙালি জাতি ও বিশ্ববাসীর চাপে কারগার থেকে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে পাকিস্তানিরা। সেই নেতা, সেই পিতা, সেই মহানায়ককে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশের সেনাবাহিনীর কিছু বিপদগামী সদস্য স্ব-পরিবারে হত্যা করলো। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে অনেক আগেই দেশটা হত স্বপ্নের সোনার বাংলা।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত ‘বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ’ নামক তার বইতে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ১৯৭৩ থেকে ২০১১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মোট দেশজ উৎপাদনের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াতো ৯ শতাংশ। এ হিসেব নিরূপণে বিভিন্ন যৌক্তিক অনুসিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ধরে নিয়েছি যে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ২০১১ সাল নাগাদ (তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স হতো ৯০ বছর) তিনি মোট ৭টি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পূর্ণ সময়সহ অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম ৩ বছর সময় পেতেন।’

সেই কারণেই হয়তো আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘একজন ব্যক্তির শারীরিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক মিশনকে হত্যা করা যায় না। কারণ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে; কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নেই।’

কোনো দলীয় মোড়কে আবদ্ধ না রেখে জাতীয় নেতা ও বীর হিসেবে আজীবন যথাযথ সম্মান বজায় থাকুক এই মহানায়কের। জাতির ললাট থেকে জনকের প্রতি অকৃতজ্ঞতার কলংকটুকু মুছে যাক। সূর্যের আলোর মতোই উদ্ভাসিত হয়ে বঙ্গবন্ধু’র নাম বাংলার মানুষের হৃদয়ে চির জাগরুক থাকুক।

এফএইচএস/এমবিআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।