মানবতাবিরোধী অপরাধ : অর্ধশত আসামি ৩ মামলার
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তিন মামলায় অর্ধ শতাধিক আসামির বিরুদ্ধে ঈদের পর পরই তদন্ত প্রতিবেদন দখিল করবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। তবে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় আরো প্রায় ছয় হাজার মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সকল মামলারই প্রতিবেদন প্রস্তুত করে জমা দেয়া হবে।
জানা গেছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের তত্তাবধানে প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে তদন্ত সংস্থা। তদন্ত করতে গিয়ে আরো কিছু নতুন রাজাকারের নাম বের হয়ে আসায় নতুন করে আবারো তদন্ত করতে হচ্ছে এসকল মামলার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তারা বলছেন, মামলাগুলো হলো কক্সবাজারের মহেশখালী, নোয়াখালীর সুধারাম ও কিশোরগজ্ঞের নিকলীর। উক্ত তিন মামলার সঙ্গে সঙ্গে আরো পাঁচ মামলার তদন্ত চলছে বলেও জানা গেছে।
মামলাগুলো হলো, হবিগঞ্জের লাখাই থানার লিয়াকত আলী, গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানীর এনায়েত মোল্লার, পটুয়াখালী সদরের আয়নাল খাঁ এবং গলাচিপার মো. আশরাফ আলী, ব্রাক্ষ্রণবাড়িয়ার সরাইলের এমদাদুল হক ওরফে টাক্কাবালী।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউশন জানিয়েছেন ,এ মামলাগুলোর তদন্ত কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। তদন্ত শেষ হলেই এগুলোর প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। তবে এগুলো এখনও মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে।
তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক জাগো নিউজকে বলেছেন, আমাদের হাতে বেশ কিছু মামলা তদন্তের জন্য রয়েছে। আরো কিছু মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। তার মধ্যে কয়েকটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ঈদের পর পরই দিতে পারবো বলে আশা করছি। হাতে থাকা এসব মামলা শেষ হলে নতুন করে আরো মামলার তদন্ত শুরু করবো। আমরা একের পর এক মামলার তদন্ত করে যাচ্ছি। যাচাই বাছাই করেই মামলা হাতে নিতে হয়। সেক্ষেত্রে একটি মামলা হাতে নিতে সাক্ষীসহ নানা ধরনের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়। তাই একটু ধীর গতিতে কাজ করতে হয়। দ্রুত তদন্ত শেষ করে মামলা আদালতে পাঠালে তা অনেকাংশেই অসমাপ্ত থেকে যাবে।
তিনি বলেন, মহেশখালীর রাজাকার সালামত উল্লাহ খানের মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে প্রায় ৭৫ জন রাজাকারের নাম এসেছে। এদের মধ্যে ৩২ জন মারা গেছেন। বাকি ৪৩ জনের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে তেমন বড় ধরনের অভিযোগ নেই। প্রাথমিক তদন্তে ১৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্মান্তরিকরণসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ মিলছে।
দ্বিতীয় ধাপে আরো ২৪ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে তাদের বিষয়ে আরো খতিয়ে দেখা হবে। ট্রাইব্যুনাল মহেশখালীর ১৯ রাজাকারের বিরুদ্ধে দুই ধাপে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে আসামি শামসুদ্দোহা কারাগারে অসুস্থ হওয়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। অপর ১২ জন এখনো পলাতক রয়েছেন।
মামলার প্রসিকিউটর রানাদাশ গুপ্ত জাগো নিউজকে বলেন, মামলার তদন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। তদন্ত সংস্তার সাথে সমন্বয় করেই আমরা কাজ করি। সে হিসেবে মহেশখালী মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ঈদের পর পরই দেয়া হতে পারে। আটক কক্সবাজারের মহেশখালীর ৬ জনকে আরো জিজ্ঞাসার জন্য তদন্ত সংস্থার সেফ হোমে নেয়া হবে।
জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে তারা হলেন, সালামত খান উল্লাহ খান ওরফে আঞ্জুবর ওরফে ‘পঁচাইয়া রাজাকার’, মোহাম্মদ রশিদ মিয়া, জিন্নাত আলী, মৌলভী ওসমান গণি, নুরুল ইসলাম ও বাদশা মিয়া।
তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে কক্সবাজারের মহেশখালীতে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। সেখানে শতাধিক লোককে হত্যা করা হয়েছে। গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ হিন্দু ও বৌদ্ধদের মন্দির আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তিনশ বছরে পুরনো রাখাইন মন্দির ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। মহেশখালীতে হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে মুসলমান করা হয়েছে। অনেক হিন্দুকে খৎনা করা হলে তারা ইনফেকশনের কারণে মারা গেছে। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের পর পরই পুনরায় তারা হিন্দু ধর্মে ফিরেছে। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সেখানে তদন্ত করে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে। তাই আসামির সংখ্যাও বেড়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও)। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন বলেছেন, শিগগিরই এসকল মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হবে।
নোয়াখালী :
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় নোয়াখালীর সুধারাম উপজেলায় রাজাকার কমান্ডার আমির আহম্মেদ ওরফে আমির আলীসহ ৫ রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগসহ তিনটি অভিযোগ পেয়েছেন।
তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ঈদের পর তারা এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে জমা দিতে পারবে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন , আমরা তদন্তে এই ৫ রাজাকারের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ পেয়েছি। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আমির আলীসহ ৫ জন জড়িত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে আরো তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে ঈদের পর তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
মামলার প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল জানিয়েছেন, আসামি আমির আলীসহ আরো ৪ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছি। তাদের রিবুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের মতো তিনটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। তদন্ত সংস্থা প্রতিবেদন দেয়ার পর তা যাচাই বাছাই করে এক সপ্তাহের মধ্যে ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনালে দখিল করা হবে।
নোয়াখালীর সুধারামে এ ৫ আসামি সেনাবাহিনীদের পথ চিনিয়ে নিয়ে আসে। তারা পিটিআই স্কুলসহ দুই জায়গায় রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হতো।
প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল আরো বলেন, আমির আলীর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী ও সেনাবাহিনীর লোক প্রায় সুধারামে শতাধিক লোককে হত্যা করেছে। ঈদের পর তদন্ত সংস্থা রিপোর্ট প্রকাশ করার পর আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে তা যাচাই বাছাই করে ফরমাল চার্জ তৈরি করে ট্রাইব্যুনালে জমা দিব। মীর কাশেম আলীর মামলার রায়ে বলা হয়েছে , যে রাজাকার ক্যাম্পে নির্যাতন করা হয়েছে, সেখানে যারা ছিল তারাও সমভাবে দায়বদ্ধ থাকবে। সেদিক দিয়ে আমির আলীসহ ৫ জন রাজাকার সমভাবে দায়ী।
কিশোরগঞ্জ :
কিশোরগঞ্জের নিকলির রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মো. হুসাইন ও তার সহযোগী মোহাম্মদ মোসলেম প্রধানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হরিদেবনাথ জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কাজ এগিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে ঈদের পর এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান করা হতে পারে। ইতিমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে প্রাাথমিক তদন্তে হত্যা, ধর্ষণ ও অপহরণসহ ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট মামলার প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ জাগো নিউজকে বলেছেন, ইতিমধ্যে আমরা দুই রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছি। পরে মো. মোসলেম প্রধানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার পর কারাগারের পাঠানো হয়।
মোসলেম প্রধান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিকলি থানা রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ মো. হুসাইনের সঙ্গী ছিলেন। তিনি পলাতক সৈয়দ মো. হুসাইন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত রাজাকার কমান্ডার পলাতক সৈয়দ মো. হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীর ছোট ভাই। হাসান আলীকে গত ৯ জুন ফাঁসি অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল।
এসএস/এমএস