গরিবের বন্ধু ফুটপাতের আবদুস সাত্তার
রাজধানীর বকশিবাজারের মোড় থেকে একটু সামনে এগিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে প্রবেশপথের ঠিক উল্টো দিকে বুয়েট মাঠের সীমানা প্রাচীরের ফুটপাতে প্রায় ২৫ বছর যাবত নরসুন্দরের কাজ করছেন ৭০ বছরের বৃদ্ধ আবদুস সাত্তার।
সাধারণ আর ১০টা সেলুনের মতো তার সেলুনটি এক রকম নয়। ফুটপাতের ওপরে জোড়াতালি দেয়া একটি ভাঙা চেয়ার, ফাটল ধরা আয়না, মরিচা ধরা কাঁচি, তিল চিটচিটে চিরুনি, রঙ ওঠা একটি ব্রাশ, ক্ষুর, এক টুকরো ফিটকারি, একটি সাবান ও বোতলে ভরা ফিটকারির পানি- এই তার সেলুন।
মাথার ওপরে ছাউনি নেই, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কাস্টমারের চুল কাটেন-দাঁড়ি শেভ করেন। উদাম শরীর, পরনে শুধু একটি লুঙ্গি থাকে তার। সমাজের হৃতদরিদ্র শ্রেণির ভিক্ষুক, রিকশাচালক, ঠেলাগাড়িচালক, চা সিগারেট বিক্রেতারা তার কাস্টমার।
চুল কাটা কিংবা শেভ করার পর বিল নিয়ে কারো সঙ্গে তিনি দর কষাকষি করেন না, সামর্থ অনুযায়ী যে যা দেয়, তাই লুঙ্গিতে গুঁজে রাখেন। ওই এলাকায় তিনি গরিবের বন্ধু নাপিত হিসেবে সুপরিচিত।
জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় আবদুস সাত্তারের। তিনি জানান, পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার সুলতানাবাদ থেকে পেটের তাগিদে ৩০ বছর আগে ঢাকায় এসেছিলেন। শুরুর দিকে কয়েকটা বছর ঠেলাগাড়ি চালাতেন।
তিনি জানান, ঠেলাগাড়ি ঠেলতে খুব কষ্ট হতো। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর যা আয় হতো তা থেকে বাসা ভাড়া দিয়ে, খাবার খেয়ে দেশের বাড়িতে বাবা, মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানের জন্য টাকা পয়সা পাঠাতে পারতেন না। ওই সময় একদিন ঠেলাগাড়ি নিয়ে কেরানীগঞ্জ যান। সেখানে বিশ্রাম নেয়ার সময় পরিচয় হয় হারুন দফাদার নামে এক নাপিতের সঙ্গে।
হারুনের সঙ্গে আলাপকালে শারীরিক পরিশ্রম গায়ে সয়না এ কথা জানালে নাপিতের কাজ করতে পরামর্শ দেন। তিনি বলেছিলেন, এতে পুঁজি কম লাগে, গায়ে খাটা পরিশ্রম করতে হয় না। পরদিন থেকে তার কাছে গিয়ে নাপিতের কাজ শিখতে থাকেন।
কিছুদিন প্রশিক্ষণ নিয়ে পরবর্তীতে দেড়শ টাকা পুঁজি নিয়ে ক্ষুর, আয়না, ব্রাশ, চিরুনিসহ কিছু জিনিস কিনে নিজেই নাপিতের কাজে নেমে পড়েন। প্রথম দিকে কয়েক বছর চাঁনখারপুল যক্ষা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সামনে নাপিতের কাজ করলেও পরবর্তীকালে ঢামেক হাসপাতালের বিপরীতে বুয়েট সীমানা প্রাচীরের ফুটপাতে এসে নাপিতের কাজ করতে থাকেন।
তিনি আরো জানান, এখানে যারা আসেন তারা সবাই আমার মতোই গরিব। তাই কারো কাছ থেকে নির্দিষ্ট অংকের টাকা চেয়ে নেন না। তওফিক অনুযায়ী চুল কেটে কেউ ২০ টাকা কেউ ৩০ টাকা দেন। শেভ করে কেউ ১০ টাকা কেউ ১৫ টাকা দেন।
আবদুস সাত্তার স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন বাড়িতে মাসিক ছয় হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকেন। প্রতিদিন ১৫০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা রোজগার হয়। তার একার আয়ে সংসার চলে না। দুই ছেলে এখন এলিফ্যান্ট রোডের দুটি দোকানে সেলসম্যানের চাকরি করে। তিনজনের আয়ে কোনো রকমে সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন বলে জানালেন।
খালি গায়ে কেন থাকেন জানতে চাইলে বলেন, গরিব মানুষ, ফুটপাতের ওপর ধুলাবালি-ময়লার কারণে শার্ট তাড়াতাড়ি ময়লা হইয়া যায়। তাই সকালে আইসা জামা খুলে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখি। ভাঙা চেয়ার, ফাটল ধরা আয়না, তিল চিটচিটে চিরুনি বদলে নতুন কিনছেন না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে হেসে বলেন, গরিব মাইনষের এই সব দেখনের সময় নাই, কোনো মতে চুলদাঁড়ি কাটতে পারলেই তাদের সারে।
বৃষ্টি এলে কী করেন জানতে চাইলে তিনি আঙ্গুল দিয়ে ফুটপাতের ওপর একটি পরিবারের প্লাস্টিক ঘেরা ছাউনি দেখিয়ে বলেন, ওই খানে গিয়া আশ্রয় নেই।
ওই সময় তার কাছে চুল কাটাচ্ছিলেন রুহুল আমিন নামের একজন ভিক্ষুক। চুল ন্যাড়া করে সাত্তারের হাতে ২৫ টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, কয়েকদিন ধরে শরীরটা খারাপ যাচ্ছে, ভিক্ষা করতে পারিনি। তাই কমই দিলাম। কোনো কথা না বলে সাত্তার টাকা লুঙ্গিতে গুঁজে রাখলেন।
রুহুল আমিন জানালেন, দুই তিন মাস পর পর এসে তার কাছে নিয়মিত চুল দাঁড়ি কাটান। টাকা পয়সা দেয়া নিয়ে তিনি কখনো কাউকে কিছু বলেন না। তিনি এলাকাতে গরিবের বন্ধু নাপিত আবদুস সাত্তার নামে পরিচিত বলে জানালেন ভিক্ষুক রুহুল আমিন মিয়া।
এমইউ/বিএ/এমএস