স্বপ্ন পূরণের আশায় এক টাকার মাস্টার
চল্লিশ বছর ধরে গাইবান্ধার নদী ভাঙন কবলিত পরিবারের শিশুদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। প্রথাগত শিক্ষক তিনি নন, এজন্য প্রচুর টাকা পয়সাও নেন না। দিনমান অভুক্ত থেকে পায়ে হেঁটে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া শেখাবার কাজটিকে তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। আর এই মহান কাজটি করছেন গাইবান্ধার লুৎফর রহমান মাস্টার। তিনি এক টাকার মাস্টার নামেই পরিচিত।
অসাধারণ এই মানুষটিকে পেতে হলে জেলা শহর থেকে বালাসীঘাট সড়ক ধরে ফুলছড়ির মদনের পাড়া হয়ে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে যেতে হবে। সেখানেই সদর উপজেলার বাগুড়িয়া গ্রাম। গ্রামের এক কোণে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ছোট্ট টিনের ঘরে বাস করেন তিনি। তবে তাকে পেতে হলে লুৎফর মাস্টার নয়, এক টাকার মাস্টার বলে খুঁজতে হবে।
সম্প্রতি বাগুড়িয়া গ্রামে গিয়ে জানা গেলো তার সম্পর্কে। গ্রামবাসী জানালেন, প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি থেকে বের হন তিনি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে শিশুদের লেখাপড়া শেখান। একটি বাইসাইকেল কেনার ক্ষমতা নেই তার। তাই মাইলের পর মাইল ক্রমাগত হেঁটেই তিনি যাতায়াত করেন। ছাত্র-ছাত্রীরা তার অপেক্ষায় বসে থাকে। কখনো রাস্তার ধারে, বাঁধে, কারো বাড়ির উঠোনে, কখনো গাছ তলায় । পাঠদান শেষে ছোটেন আরেক গ্রামে।
প্রতি দিনের রুটিন অন্তত ১০ ঘণ্টার। গ্রামও ঠিক করা থাকে। পড়া শেষে দিনে ছাত্র প্রতি গ্রহণ করেন মাত্র এক টাকা। সারা দিন প্রায় চল্লিশজন ছাত্র পড়িয়ে তার হাতে আসে চল্লিশ টাকা। তাতেই তিনি খুশি। সকাল দুপুর কেউ খেতে দিলে খান, নইলে একগাল মুড়ি চিবিয়ে দিব্যি কাটিয়ে দেন। প্রতিদিন ৪০ টাকা নিজের সংসারের প্রয়োজনে দেন। এই হচ্ছে তার এক টাকার মাস্টার হওয়ার পেছনের কাহিনী।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম সাদেক লেবু জানান, লুৎফর রহমান এভাবেই ছেলেমেয়েদের পড়ান। অভাব অনটন কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। বাগুড়িয়া, মদনের পাড়া, পুলবন্দি, চন্দিয়া, ঢুলিপাড়া, কঞ্চিপাড়া ও পূর্বপাড়ায় এ পর্যন্ত শতশত ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছেন। তার অনেক ছাত্র এখন সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত।
গাইবান্ধার শিক্ষাবিদ মাজহার উল মান্নান জানান, তাকে আমি খুব কাছ থেকে চিনি। এই মানুষটি নিরবে নিভৃতে অবহেলিত-দরিদ্র পরিবারের মানুষের সন্তানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। এর কোন তুলনা হয় না।
বাগুড়িয়া গ্রামে গিয়ে দেখা মিললো তার। এক দল ছেলেমেয়েকে পড়াচ্ছিলেন। জানালেন, ১৯৫০ সালে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়ায় জন্ম তার । বাবা মৃত ফইমুদ্দিন ব্যাপারী। ১৯৭২ সালে ফুলছড়ি উপজেলার গুণভরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১০০ বিঘা জমি ছিল তাদের। মুক্তিযুদ্ধের পর নদী ভাঙনে সব হারিয়ে সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের বাগুড়িয়া গ্রামের ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়ে কোনো মতো মাথা গুজে আছেন।
স্ত্রী লতিফুল বেগম জানালেন, শিক্ষা পাগল লোকটা সারাদিন শুধু ছাত্র পড়ান। তিনিই দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে লাভলু এসএসসি পাস করার পর অর্থাভাবে আর পড়তে পারেনি। এখন অটোরিকশা চালায়। ছোট ছেলে মাদরাসায় পড়াশোনা করে। এখন বড় ছেলের সামান্য আয় দিয়ে কোনো মতো সংসার চলে।
লুৎফর রহমান জানালেন, আমার কোন চাওয়া নেই। এই সকল শিশুদের আলোকিত মুখ দেশকে উজ্জ্বল করলেই আমার পরিশ্রম আর স্বপ্ন স্বার্থক হবে।
অমিত দাশ/এসএস/এমএস