মেডিকেল কলেজে মৌলিক বিষয়ের সিনিয়র শিক্ষকের সংখ্যা কমছে
দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে মৌলিক বিষয়ে পাঠদানের জন্য অভিজ্ঞ ও সিনিয়র শিক্ষকের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে কমছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১০০টিরও বেশি মেডিকেল কলেজ পরিচালিত হলেও অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মৌলিক বিষয়ে পাঠদানের জন্য ন্যূনতম সংখ্যক শিক্ষক নেই। ফলে হাজারো শিক্ষার্থীর একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
অধিকাংশ মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের পদের তুলনায় শিক্ষক স্বল্পতার কারণে সাধারণ এমবিবিএস পাস করা ডাক্তাররা শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, সঠিক পরিসংখ্যান বলা না গেলেও মৃত্যু, অবসর ও চাকুরি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগজনিত কারণে শতকরা ৫০ ভাগের বেশি মেডিকেল কলেজে মৌলিক বিষয়ের শিক্ষকের সংকট রয়েছে।
তিনি জানান, অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, ফরেনসিক মেডিসিন, ফার্মাকোলজি ও প্যাথলজিকে মৌলিক বিষয় বলা হয়। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে আন্ডারগ্রাজুয়েট এমবিবিএস কোর্সের শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাতটি মৌলিক বিষয়ের দু`একটি ছাড়া অধিকাংশ বিষয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ না থাকায় জুনিয়র ডাক্তারদের কেউ আর এখন এসব বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষকতা পেশায় আসতে চাইছেন না।
চিকিৎসা-শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সময় মৌলিক বিষয়গুলোতে সবচেয়ে মেধাবী ডাক্তাররা আসতেন। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য ভর্তির জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতো। এ বিষয়গুলোতে ভর্তি হতে পারাটাকে সম্মানের চোখে দেখা হতো।
কিন্তু কালের পরিক্রমায় বর্তমানে ডাক্তাররা এ বিষয়ে আসতে চাইছেন না। সদ্য এমবিবিএস পাস করা ডাক্তারদের গ্রামে দুই বছর চাকরির বাধ্যবাধকতামূলক শর্ত শিথিল করে প্রভাষক পদে নিয়োগের প্রস্তাব দেয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত সাড়া মিলছে না।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, যে সকল বিষয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের মাধ্যমে ভালো আয় রোজগারের সুযোগ রয়েছে সে সব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা এমডি, এমএস ও ডিপ্লোমা কোর্সের ভর্তি পরীক্ষায় মোট আসনের বিপরীতে বহুগুণ প্রার্থী আবেদন করলেও মৌলিক বিষয়ে সবচেয়ে কম সংখ্যক আবেদন জমা পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টির ডিন ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল খান জাগো নিউজকে বলেন, মৌলিক বিষয়ে সিনিয়র শিক্ষকের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, মৌলিক বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রিতে ডাক্তারদের উৎসাহিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে মৌলিক শিক্ষকের অভাবে আন্ডারগ্রাজুয়েট চিকিৎসা শিক্ষা হুমকির মুখে পড়বে।
জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুজ্জামান চৌধুরী আগামী ২/৩ মাস পরেই অবসরে যাচ্ছেন। ফরেনসিক মেডিসিন বিষয়ে সারাদেশে যে দুইজন অধ্যাপক রয়েছেন তিনি তাদের একজন। সিনিয়র শিক্ষক স্বল্পতার কারণে তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য প্রচেষ্টা চলছে।
হাবিবুজ্জামান চৌধুরীর মতো আরো মৌলিক বিষয়ের অনেক সিনিয়র শিক্ষকের পদ শূন্য হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত বছর সরকারি বিভিন্ন নতুন মেডিকেল কলেজ যেমন সাতক্ষীরাতে শেখ সায়েরা খাতুন, কিশোরগঞ্জে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, নোয়াখালীতে আবদুল মালেক উকিল ও কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য ডাক্তারদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করে।
নিয়োগের ক্ষেত্রে ডাক্তারদের দুই বছর গ্রামে বাধ্যতামূলক অবস্থানের শর্ত শিথিল করে এক বছর করা হয়। কিন্তু আবেদনপত্রের স্বল্পতা দেখে হতাশ হন সংশ্লিষ্টরা।
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ ই মাহবুবের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি মেডিকেল কলেজে নিয়মিত প্রভাষকের পদের স্বল্পতার কারণে ডাক্তাররা এ সব বিষয়ে আসতে চাইছেন না।
তিনি বলেন, মৌলিক বিষয়ে শিক্ষক সংকট কাটাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও ডাক্তারদের এসব বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে বিভিন্ন ধরনের উৎসাহব্যঞ্জক প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৩৩তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তার থেকে বেশ কিছু সংখ্যক ডাক্তারকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এমইউ/এসকেডি/বিএ/আরআইপি