সভ্যতার সংকট
সিরিয়া-ইরাকের সন্ত্রাসী গোষ্ঠি আইসিস বা আইএস-এর উত্থানের পর উদ্বেগ আর অস্বস্তি থাকলেও, বিশ্বব্যাপী একটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ছিল এমন যে এরা বেশিদিন টিকবে না। কিন্তু লন্ডন থেকে একসাথে একই পরিবারের ১২ জন সদস্যের এদের সাথে যোগ দিতে বাংলাদেশ হয়ে সিরিয়া চলে যাওয়া, সেই অঞ্চলের বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের এই সন্ত্রাসী শক্তির সাথে যোগ দেয়ার হিড়িকে বোঝা যাচ্ছে, এরা অতি সংঘবদ্ধ। একের পর এক অঞ্চলে এদের প্রকাশ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এরা আর এখন একটি মাত্র সংগঠন নয়, এদের সাথে আছে এমন আরো গোষ্ঠি।
তিউনিসিয়ায় সমুদ্র সৈকতে হামলা করে পর্যটক খুন করা, পাঁচ তারকা হোটেল টার্গেট করা, মিশনের সিনাই উপত্যকায় যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, সৌদি আরব বা কুয়েতের মসজিদে হামলা করে এরা বুঝিয়ে দেয় একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে এরা এগুচ্ছে।
শিরশ্ছেদসহ বীভৎস সব কাণ্ড করে এরা প্রকারান্তরে মানবতারই শিরশ্ছেদ করে চলেছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় এই যে, ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক সীমান্তে যা ঘটাচ্ছে এরা, তার প্রতি বিশ্বব্যাপী সমবেত সংগঠিত প্রতিবাদ খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। স্মরণকালের মধ্যে সভ্যতার সবচেয়ে বড় সংকটকাল চলছে এখন। কোনো কিছুকেই বাদ দিচ্ছে না এরা। এরা সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে, এরা ধর্মপ্রাণদের মাথা কেটে নিচ্ছে, এরা মসজিদে প্রার্থনারত মানুষকে বোমায় উড়িয়ে দিচ্ছে, এরা নারীদের যৌনদাসী বানিয়ে ভোগের এক জংলি রাজত্ব কায়েম করছে, এরা প্রাচীন নিদর্শন নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে ইতিহাসকে ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে।
এতসব যারা করছে, মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে যারা এমন ধংসাত্মক তৎপরতায় লিপ্ত, তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের কণ্ঠ এমন নিরব কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর মেলে না সহজে। বুঝতে কষ্ট হয় না যে, আমাদের সংবেদনশীলতা কমে আসছে। দেশে দেশে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে যে, আলো প্রত্যাশী মানুষ আজ শংকিত, কুণ্ঠিত, স্তম্ভিত। এমন ভয়ংকর বিপদে সকলের চুপ করে থাকা আরো ভয়ের জানান দেয়।
আইসিস বা আইএস যে সভ্যতা বিরোধী, মানবতবিরোধী কাজ করছে, তার প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে দেশে দেশে, এমনকি পশ্চিমা সমাজেও। তাইতো লন্ডনের তিন শিক্ষিত তরুণী পরিবারকে না বলে চলে যায় সিরিয়ায়। কিসের মোহে যায় এরা? তবে কি এসব মানুষের বুদ্ধির নাব্যতা কমে যাচ্ছে?
যদি বিশ্ববাসী ভেবে থাকে, এটি মরুর দেশের সমস্যা কেবল, তবে ভুল করবে। এরা ভয়ংকরভাবে গ্রাস করছে সভ্যতার সব ভূমিকে। বাংলাদেশের মতো মডারেট মুসলিম দেশগুলোতে ভর করছে সেই মানসিকতার গোষ্ঠি, জঙ্গি সংগঠন। আর দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, এদের পক্ষে আছে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছে, সাধারণ রাজনৈতিক দলগুলো। এমন বিপন্নতা থেকে আমাদের মুক্তির উপায় তাহলে কী?
উপায় হলো, দেশ- মহাদেশ নির্বিশেষে সভ্য মানুষের বুঝতে পারা যে, এটি কোনো একক দেশ বা অঞ্চলের সমস্যা নয়। জেগে উঠতে হবে একসাথে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের উদারমনা মানুষের ঐক্য আর সরব সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ, বিশ্বের গণমাধ্যমের একসথে গর্জে উঠার এখনই সময়।
তালেবানরা যখন আফগানিস্তানে বৌদ্ধমূর্তি ধ্বংস করে তাদের স্বরচিত অনুশাসনের কীর্তন শুরু করেছিল, তখন বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। অনেক রাষ্ট্র সরাসরি হস্তক্ষেপও করেছিল। তালেবানরা পরাজিত হয়েছিল। কিন্ত নির্মূল হয়নি তারা। আজও পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশগুলিতে ও আফগানিস্তানের নানা স্থানে জঙ্গিদের লাগামহীন সন্ত্রাস অব্যাহত৷ তালেবানদের ব্যাপারে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও সমাজের যে দ্বিচারিক চরিত্রের প্রকাশ দেখছি, মনে হচ্ছে, আইসিসের ব্যাপারেও এমনটা ঘটছে। সন্ত্রাসের আঘাত এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে৷ ইউরোপ, আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া, কোনো অঞ্চলই বাদ নেই।
পশ্চিমা শক্তির বুঝতে হবে দেশে দেশে বিশ্ব শান্তির জন্য, তাদের নিজেদের স্বস্তির জন্য মধ্যপন্থি ও ধর্মনিপেক্ষ রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে সমর্থন করা ছাড়া এখন আর কোনো বিকল্প নেই। কোনো ধরনের গাণিতিক কারণে চরমপন্থি রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির সামান্যতম সমঝোতা অন্যান্য অঞ্চলেও সিরিয়া- ইরাক-লিবিয়া পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
ধর্ম, ধর্মীয় ভাবাবেগ, অনুশাসনের নৈতিক সত্যকে উপেক্ষা ও অস্বীকার করে আইসিস, আল-কায়েদা, তালেবান আর বোকো হারামরা যেভাবে শিরশ্ছেদ করছে, সভ্যতার নিদর্শন ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে চলেছে, যেভাবে হাজার হাজার বই পুড়িয়ে দিচ্ছে, তার সাথে ধর্মের সম্পর্ক কোথায়? নারী সমাজ আজ তাদের কাছে ভোগের সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়। এ সব বীভৎস, কদর্য, উগ্র গোষ্ঠির মোকাবিলায় বিশ্বজোট গঠন করতে হবে খুব শীঘ্রই। এখানে হিসেবি পদক্ষেপের কোনো সুযোগ আর নেই। এখনো কোনোরকমে টিকে থাকা ধর্মনিরপেক্ষ, মডারেট দেশগুলিতে এমন শক্তির বিকাশ ঠেকাতে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে সামরিক আর অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশগুলিকে। সমস্বরে ধ্বংসকামীদের বর্বরতা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধ বিশ্ববিবেকের প্রতিরোধের এখনই সময়।
এইচআর/এমএস