মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে কাজ করছি : প্রধানমন্ত্রী
বিশ্বের তৃতীয় সৎ নেতা নির্বাচিত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে জীবনকে বাজি রেখে বাংলার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। টাকা পয়সা আছে কি-না তা কখনও চিন্তা করি না। এছাড়া অনেক সময় দিনে সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমাতেও পারি না।
বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামের সম্পূরক প্রশ্নে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। এ সময় সংসদে সভাপতিত্ব করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
ফখরুল ইমাম তার প্রশ্নে ওই প্রতিষ্ঠানের গবেষণার বিস্তারিত তুলে ধরেন। অনুসন্ধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার সরকারের দুর্নীতি হওয়ায় তিনি নম্বর কম পেয়েছেন। ১৭৩ জন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও সৎ সরকারপ্রধান হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল। পাঁচটি প্রশ্নে মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে তিনি পেয়েছেন ৯০। দ্বিতীয় স্থানে থাকা সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লং পেয়েছেন ৮৮। ৮৭ নম্বর পেয়ে তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮৫ নম্বর পেয়ে চতুর্থ সৎ সরকারপ্রধান বিবেচিত হয়েছেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইরনা সোলাবার্গ। আর ৮১ নম্বর পেয়ে এ তালিকায় পঞ্চম স্থানে আছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কী পেলাম, কী পেলাম না, সে হিসাব মিলাতে আসিনি। সে হিসাবটাও আমার নেই। আমার একটাই হিসাব দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কতটুকু কাজ করতে পারলাম।
তিনি বলেন, আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই যাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে তাদের দেশে জনসংখ্যা কত? আর আমার দেশের জনসংখ্যা কত? এটা যদি তারা একটু তুলনা করতেন তাহলে হয়তো অন্য হিসাব আসত।
শেখ হাসিনা বলেন, ৫৪ হাজার বর্গ মাইলের মধ্যে ১৬ কোটির বেশি মানুষ বসবাস করে। আমাদের দেশের পরিবেশই তো আলাদা। এক নম্বর, দুই নম্বর বা চার নম্বরে যারা আছেন তাদের বাবা-মা, ভাই-বোন হারাতে হয়নি বা নির্যাতিতও হতে হয়নি। জেলে যেতে হয়নি। মিথ্যা মামলার মুখোমুখি হতে হয়নি। এমনকি বারবার মৃত্যুর মুখেও দাঁড়াতে হয়নি। তাদের একজনকেও গ্রেনেড হামলার শিকার হতে হয়নি। আমার জীবনের ওপর বারবার হামলা এসেছে। তাদের ওপর যদি একবারও এমন হতো তাহলে অনেকেই ঘরে বসে থাকত।
তিনি বলেন, আল্লাহ জীবন দিয়েছেন, জীবন তো চলেই যাবে। দেশে যে প্রতিকূলতা সেই প্রতিকূলতার মধ্যে তাদের যেতে হয়নি। দেশে গণতন্ত্র ছিল না, তা ফিরিয়ে এনে দেশ পরিচালনা করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘১২-১৪ ঘণ্টার হিসাব নেই। অনেক সময় অনেক দিনে সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমাতেও পারি না। যখনই কাজ আসে তখনই কাজ শুরু করতে হয়। এ কাজগুলো করি মনের টানে। কারণ আমার বাবা দেশটাকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। তার স্বপ্ন ছিল দেশকে ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়বেন। আমার একটাই চ্যালেঞ্জ যে কাজটা আমার বাবা করে যেতে পারেননি সে কাজটা আমি সম্পন্ন করব।
তবুও আমি বলব এ মূল্যায়নটা যারা করেছেন তারা তাদের মতো করে করেছেন।
এ সময় হাস্যোজ্জ্বল শেখ হাসিনা বলেন, মাননীয় সংসদ সদস্য এটা যে তুলবেন সেটা আমি জানতাম না। উনি সবসময় অনেক তথ্য নিয়ে এসে বক্তব্য রাখেন। এটি সম্পূরক প্রশ্ন হয়নি। তবুও স্পিকার আপনি সুযোগ দিয়েছেন আমি কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ওই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের কিছু দুর্নীতির কারণে শেখ হাসিনা পিছিয়ে গেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে দেশে মিলিটারি ডিকটেটরশিপ চলে, যে দেশে অবাধ গণতন্ত্রের অভাব থাকে, যে দেশে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অভাব থাকে সেই দেশে দুর্নীতির শিকড় গেড়ে যায়। সেই শিকড় ওপড়ে ফেলা কঠিন। ৭৫ এর পর থেকে ২১ বছরই কিন্তু দেশে এ অবস্থা ছিল। এরপর আবার ২০০১-০৮ পর্যন্ত এ অবস্থা। অর্থাৎ আমার লিগেসিটা কি? আমি উত্তরাধিকার সূত্রে কি পেয়েছি? পেয়েছি স্বৈরশাসন, অনিয়ম, অবিচার, অত্যাচার, যার কারণে এ দুর্নামের এখনও ভাগিদার হলাম।
তিনি বলেন, আমি নিজে শততার সঙ্গে দেশ চালাতে চেষ্টা করছি। একটি কথা মনে রাখবেন মাথায় পচন ধরলে সারা শরীরেই তা ছড়িয়ে যায়। যেহেতু মাথায় পচন নেই, শরীরে কোথাও একটু আধটু ঘা থাকলে সেগুলোও শেষ করতে পারব।
তিনি বলেন, ওই রকম যদি দুর্নীতি হতো তাহলে দেশে জিডিপি ৭ দশমিক ২৮ ভাগ হতো না। বড় বড় দুর্নীতি যদি হতো মাথাপিছু আয় এক হাজার ৬১০ ডলারে উন্নীত হতো না। এত বড় বড় প্রকল্প অল্প সময়ে বাস্তবায়ন সম্ভব হতো না। এ দুর্নীতিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে কিন্তু আমরা পদ্মা সেতু তৈরি করছি। সততাকে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি।
তিনি বলেন, ধন-সম্পদ চিরদিন থাকে না। মানুষ মরণশীল। সব রেখে চলে যেতে হবে। তবুও মানুষ অবুঝ, ধন-সম্পদের লোভে অস্থির হয়ে পড়ে। এটা মানুষের একটা প্রবৃত্তি। এ প্রবৃত্তিটাকে যে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সেই পারে দেশকে দিতে। জনগণকে দিতে। আমরা এখানে দিতে এসেছি। এজন্য জীবন বাজি রেখেছি যেন দেশটা বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলে। এ রিপোর্টে আমার মর্যাদার চেয়ে দেশের মানুষের মর্যাদা উন্নত হয়েছে। এটাই আমার কাছে বড় পাওয়া।
প্রসঙ্গত, বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্স’ পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেতৃত্বের সততার মান বিচার করেছে। প্রথম প্রশ্ন ছিল, সরকার/রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে তিনি কি তার রাষ্ট্রের বাইরে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করেছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, ক্ষমতায় আসীন হবার পর তার ব্যক্তিগত সম্পদ কতটুকু বেড়েছে। তৃতীয় প্রশ্ন ছিল, গোপন সম্পদ গড়েছেন কিনা। চতুর্থ প্রশ্ন সরকার/রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ আছে কি-না। আর পঞ্চম প্রশ্ন ছিল, দেশের জনগণ তার সম্পর্কে কী ভাবেন?
পিপলস অ্যান্ড পলিটিক্সের গবেষণায় দেখা গেছে, শেখ হাসিনার দেশের বাইরে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। সংস্থাটি গবেষণায় দেখেছে, বেতন ছাড়া শেখ হাসিনার সম্পদের স্থিতিতে কোনো সংযুক্তি নেই। শেখ হাসিনার কোনো গোপন সম্পদ নেই বলে নিশ্চিত হয়েছে পিপলস অ্যন্ড পলিটিক্স। শেখ হাসিনাকে দেশের ৭৮ ভাগ মানুষ মনে করেন সৎ এবং ব্যক্তিগত লোভ লালসার ঊর্ধ্বে। তবে, তার সরকারের বিরুদ্ধে কিছু দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে বলে সংস্থাটির গবেষণা প্রতিবেদেনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এইচএস/এএইচ/ওআর/এমএস