কলেজ অধ্যক্ষের মাসিক আয় ১৪৯ টাকা


প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ০১ জুলাই ২০১৫

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের বাকাই গ্রামে প্রতিষ্ঠিত `বাকাই হরি গোবিন্দ সংস্কৃত কলেজ` অধ্যক্ষের মাসিক আয় ১৪৯ টাকা ৫০ পয়সা। সে হিসেবে তার বার্ষিক আয় ১ হাজার ৭শ ৯৪ টাকা। তাও আবার এক বছর পর উত্তোলন করতে হয় বিলের মাধ্যমে।

অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই বাস্তব। এই কলেজে কর্মরতদের নেই কোন বেতন-ভাতা। তারা শুধু পেয়ে আসছেন মহার্ঘ ভাতা। তবে অবৈতনিক এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় কর্মরত হাজার হাজার মানুষ। পাশাপাশি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত অনেকে সুনাম কুড়িয়েছেন।

সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্কৃত ও পালি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পরিচালিত দেশের সংস্কৃত কলেজ ও টোলগুলোতে কর্মরত শিক্ষকদের একই অবস্থা।

বাকাই হরি গোবিন্দ সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী নিখিল রায় চৌধুরী বলেন, ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ও অত্র অঞ্চলের বিখ্যাত পণ্ডিত হরি গোবিন্দ রায় চৌধুরী ১২২ বছর আগে বাংলা ১৩০০ খ্রি.  মোতাবেক ইংরেজি ১৮৯৩ সালে নিজের ১ একর ১০ শতক জমির উপর নিজ নামে প্রতিষ্ঠা করেন `বাকাই হরি গোবিন্দ সংস্কৃত কলেজ।` ওই যুগে বাবা-মায়েরা তাদের ছেলে মেয়েদের পড়াশুনার জন্য পণ্ডিত মহাশয়ের টোল বা পাঠশালায় দিতেন। কালক্রমে ওই সকল টোল থেকে কলেজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

হরি গোবিন্দ কলেজে বর্তমানে পড়ানো হয় কাব্য, ব্যাকরণ, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র, পুরাণ, পুরোহিত্য ও স্মৃতি শাস্ত্রসহ ছয়টি বিষয়। প্রত্যেক বিষয়ে তিন বছর মেয়াদী শিক্ষার্থীদের অধ্যায়ন করতে হয়। এরপর প্রাতিষ্ঠানিক সনদপত্র নিয়ে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন লক্ষাধিক শিক্ষক। শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি এই কলেজে অধ্যায়ন করে সামাজিক, সাস্কৃতিক ও ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করে সম্মান সূচক ডিগ্রি নেন অনেক পেশার লোকজন। যাদের নামের আগে সম্মানের সাথে সংযুক্ত করা হয় আচার্য, পণ্ডিত, শাস্ত্রবিদ ইত্যাদি।

সেই পণ্ডিত আর শাস্ত্রবিদ তৈরির শিক্ষকরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে ধর্মীয় ও শাস্ত্রীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করলেও তাদের ভাগ্যে জোটেনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। বর্তমান সমাজে চরমভাবে অবহেলিত ও উপেক্ষিত এই সকল কলেজের শিক্ষকরা। ফলে আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।

অধ্যক্ষ নিখিল রায় চৌধুরী আরো বলেন, ১৯৮৮ সাল থেকে অধ্যক্ষের দ্বায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এই সময়টুকুর মধ্যেই অনেক ছাত্র এখান থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করে রাষ্ট্রের বড় বড় পদে আসীন হয়েছেন। তারা জানেন, যে কলেজের কি হাল ? তারপর তারা নিজেদের অবস্থান থেকে একটু নজর দেয়নি কলেজের দিকে। অথচ এই কলেজে অধ্যয়ন করে শিক্ষা সনদ গ্রহণ করেছেন সচিব, ডিসি, উপমহাদেশের বিখ্যাত পণ্ডিত থেকে শুরু করে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ও উপমহাদেশের বিখ্যাত শাস্ত্রজ্ঞরা।

ক্ষোভে তিনি আরো বলেন, অনেক পণ্ডিতই চান না যে সংস্কৃত কলেজের উন্নয়ন হোক। অবশ্য এর পিছনের কারণ তিনি বলেননি। এমন অর্থনৈতিক দৈন্য দশার মধ্যে কেন এই কলেজে চাকুরি করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, পূর্ব পুরুষেরা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে সমাজের উন্নয়ন করার জন্য। তাই তাদের সেই মহৎ চিন্তা চেতনার দিকে তাকিয়ে তাদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য বিনা বেতনে কাজ করছি।

কলেজ অধ্যক্ষ নিখিল রায় চৌধুরী বলেন, সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংস্কৃত ও পালি শিক্ষাবোর্ডর আওতায় কলেজ পরিচালিত হচ্ছে। পালি বোর্ড ঢাকার কমলাপুরের বাসাবো বৌদ্ধ মন্দিরে অবস্থিত। কলেজগুলোতে অধ্যক্ষসহ তিনজন শিক্ষক ও একজন অফিস সহকারী কর্মরত রয়েছেন। আর টোলগুলোতে দুইজন শিক্ষক ও একজন অফিস সহকারী দিয়ে চলছে শিক্ষা ব্যবস্থা। বর্তমান শিক্ষাবর্ষে তার কলেজে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেবেন বলেও জানান তিনি।

পরীক্ষায় কৃতকার্যদের সনদপত্র দেয়া হয় মন্ত্রণালয় থেকে। তিনি আরো বলেন, বরিশাল বিভাগের একমাত্র কলেজ এটা। এছাড়া একটি টোল আছে বরিশাল সদরের ধর্মরক্ষণী সভায়। সারাদেশে ৮ থেকে ১০টি কলেজ থাকার কথাও জানান তিনি। হাতে গোনা কয়েকটা কলেজ থাকলেও সরকারের উদাসীনতার কারণে এর পাঠ্য বই পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যায় না। পাঠ্য বই সংগ্রহ করতে হয় ভারত থেকে।

অভিযোগ করে তিনি আরো বলেন, সনাতন ধর্ম বিকাশের কারণে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা কলেজের অবকাঠামোসহ তাদের পাড়ার ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের বাড়িগুলো পুড়িয়ে দেয়। অত্যাচারিত হয়ে প্রাণ বাঁচাতে দেশান্তরিতও হয় অনেকে। তারপরও দেশ স্বাধীনের পর কোন রকমে গড়ে তোলা হয় কলেজ অবকাঠামো। ২০০১ সালে ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ থেকে তিন তলার একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। ওই ভবনেই চলছে শিক্ষাসহ আবাসনের কাজ। আজ পর্যন্ত ক্যাম্পাসে গড়ে ওঠেনি কোন আলাদা ছাত্রাবাস। অথচ ছাত্রবাসে থেকেই শিক্ষার্থীদের অধ্যায়ন করার কথা থাকলেও সুযোগের অভাবে শিক্ষার্থীরা আবাসিক সুবিধায় থাকতে পারছে না।

কলেজ প্রতিষ্ঠাতার ছেলে বিমল রায় চৌধুরী বলেন, কেন যে বাবা এই প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন জানি না। এ প্রতিষ্ঠান থেকে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা লেখাপড়া করে সনদপত্র গ্রহণ করেছে তারা প্রতিষ্ঠানের কথা মনেই রাখেন না। তারা যদি প্রতিষ্ঠানের কথা মনে রাখতেন তবে তাদের প্রচেষ্ঠায়ই একটু হলেও কলেজে কর্মজীবীদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটতো।

একই ক্যাম্পাসে রয়েছে মাধ্যমিক ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই সকল প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তাদের আর্থিক সচ্ছলতা আর সংস্কৃত কলেজে কর্মরতদের আর্থিক অবস্থা বিপরীত চিত্র রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় বৈষম্যকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তুলে ধরেছে।    

বাকাই হরি গোবিন্দ সংস্কৃত কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালক অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার বলেন, তাদের সম্মানী নিম্ন থেকে অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ে। আর্থিক কারণে তাদের জীবনযাত্রা সত্যিই অমানবিক। সরকার সকল শিক্ষাকে যুগোপযোগী, আধুনিকায়ন ও বিজ্ঞান সন্মত করেছে।

সরকার মাদরাসা শিক্ষা আধুনিকায়ন করে আলাদা বোর্ডের মাধ্যমে বেতন কাঠামো নির্ধারণ করেছে। দেশে সংস্কৃত কলেজগুলোর সংখ্যা খুব বেশি নয়। তাই তাদের জন্য সময়োপযোগী বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে তাদের অমানবিক জীবন থেকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেয়ার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা করেন।  

সাইফ আমীন/এসএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।