এক মিনিটের পরীক্ষায় সনাক্ত হচ্ছে জরায়ু ক্যান্সার
এক মিনিটের পরীক্ষায় মহিলাদের জরায়ুর মুখের ক্যান্সার সনাক্ত হচ্ছে! রাজধানীসহ দেশের সকল সরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ভায়া (ভিজ্যুয়াল ইন্সপেকশন উইথ এসিটিক এসিড) পদ্ধতিতে কোন মহিলার জরায়ুতে ক্যান্সারের জীবাণু রয়েছে কিনা তা সহজেই নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে।
গত আড়াই বছরে ৩০ বছরের বেশি বয়সি সাড়ে ৯ লাখ মহিলাকে ভায়া পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫০ হাজার মহিলার জরায়ুতে ক্যান্সারের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে শনাক্ত হওয়ায় তাদের অধিকাংশই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন বলে জানা গেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকরা দাবি করেছেন, তাদের মাধ্যমে রাজধানীসহ সারাদেশে পরিচালিত ‘ইস্টাবলিসমেন্ট অব ন্যাশনাল সেন্টার ফর সার্ভিক্যাল অ্যান্ড ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং অ্যান্ড ট্রেনিং’ প্রকল্পের কার্যক্রমের সফলতার কারণে জরায়ুর মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগের তুলনায় দেশে মহিলাদের জরায়ুর ক্যান্সারে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার ক্রমেই কমছে। মাত্র কয়েকবছর আগেও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে যত সংখ্যক মহিলার মৃত্যু হতো তাদের মধ্যে জরায়ুর মুখের ক্যান্সারে মৃত্যুহার ছিল সর্বাধিক। বর্তমানে মহিলাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক থেকে জরায়ুর মুখের ক্যান্সার প্রথম থেকে দ্বিতীয় স্থানে নেমে এসেছে। বর্তমানে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সর্বাধিক সংখ্যক মহিলার মৃত্যু হচ্ছে।
‘ইস্টাবলিসমেন্ট অব ন্যাশনাল সেন্টার ফর সার্ভিক্যাল অ্যান্ড ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং অ্যান্ড ট্রেনিং’ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক ডা. রেহেনা আখতার জাগো নিউজকে জানান, এ প্রকল্পের আওতায় ২০১২ সালের শেষের দিকে মহিলাদের জরায়ু ক্যান্সারের পূর্ববর্তী লক্ষণ নির্ধারণের লক্ষ্যে মহিলাদের টেস্ট শুরু হয়। ২০১৪ সাল পর্যন্ত সারাদেশে সাড়ে ৯ লাখ মহিলার ভায়া টেস্ট করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, মাত্র এক মিনিটের ভায়া পদ্ধতির পরীক্ষার মাধ্যমে কোন মহিলার জরায়ুতে ক্যান্সারের জীবাণু রয়েছে কিনা তা জানা যায়। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ‘কলপসকপি’ নামে অন্য একটি পরীক্ষা করতে হয়। দেশের পুরোনো সব ক`টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, কিছু সদর হাসপাতাল ও বিএসএমএমইউতে এ পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। পরীক্ষায় ক্যান্সারের জীবাণূ রয়েছে নিশ্চিত হলেই ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় জরায়ুর মুখ থেকে ক্যান্সারের জীবানু তুলে ফেলা হয়।
অনুমিত পরিসংখ্যান অনুসারে ভায়া পদ্ধতির পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সাড়ে ৯ লাখ মহিলার মধ্যে আনুমানিক ৫০ হাজার মহিলার জরায়ুর মুখে ক্যান্সারের জীবাণু থাকতে পারে ধারণা করেন চিকিৎসকরা। প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত হওয়ার ফলে জরায়ুর মুখে ক্যান্সারে আক্রান্তদের অধিকাংশই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠছেন বলে ডা. রেহানা দাবি করেন।
দেশে মহিলাদের বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। ফ্রান্সের গ্লোবোকেন নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান অনুসারে বাংলাদেশে ২০০৮ সালে জরায়ুর মুখের ক্যান্সারে প্রায় ১৮ হাজার আক্রান্ত ও ১০ হাজারেরও বেশি মহিলার মৃত্যু হয়েছে। ২০১২ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ১২ হাজার ও মৃত্যুসংখ্যা সাড়ে ৬ হাজারে নেমে আসে। একই সময়ে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ হাজার ৭৮১ জন ও মৃত্যুসংখ্যা ছলি ৮ হাজার ৩৯৬ জন। ২০১২ সালে আক্রান্তের হার ১৪ হাজার ও মৃত্যুসংখ্যা ৭ হাজারে নেমে আসে।
জাতীয় ক্যান্সার ইনষ্টিটিউটের ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে জরায়ুর ক্যান্সারের তুলনায় স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের হার বেশি।
তিনি আরো জানান, জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে যত মহিলা রোগী এসেছে তাদের শতকরা ২৭ ভাগ স্তন ও ১৭ থেকে ২০ ভাগ জরায়ু ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিএসএমএমইউতে ‘কল্পোস্কেপি ট্রেনিং অন সার্ভিক্যাল অ্যান্ড ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম’ শীর্ষক প্রশিক্ষণের সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে জরায়ুর মুখের ক্যান্সার নির্ণয়ে নানা সফলতা ব্যর্থতা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে সনদ বিতরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান।
এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন- বিএসএমএমইউ’র প্রক্টর ও ইউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল, বিএসএমএমইউ’র রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. মো. আসাদুল ইসলাম, অবস অ্যান্ড গাইনী বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালেহা বেগম চৌধুরী, ‘ইস্টাবলিসমেন্ট অব ন্যাশনাল সেন্টার ফর সার্ভিক্যাল অ্যান্ড ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং অ্যান্ড ট্রেনিং’ প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা, প্রশিক্ষক ভারতের চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের কনসালটেন্ট ডা. শ্রাবণী মৌত্তাল প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে ‘ইস্টাবলিসমেন্ট অব ন্যাশনাল সেন্টার ফর সার্ভিক্যাল অ্যান্ড ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং অ্যান্ড ট্রেনিং’ প্রকল্পের কার্যক্রমের বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেন- উপ-প্রকল্প পরিচালক ডা. রেহেনা আখতার। প্রশিক্ষণে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকগণ অংশগ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, এ ধরণের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারী চিকিৎসকগণ স্বতন্ত্রভাবে তাদের নিজ নিজ মেডিক্যাল হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট মহিলা রোগীদের জরায়ু ক্যান্সারের পূর্ববর্তী লক্ষণের ডায়াগনোসিস করতে ও যথাযথ চিকিৎসাসেবা দিতে পারবেন। এর ফলে ভবিষ্যতে মহিলাদের জরায়ুর ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ও মৃত্যু দু’ই আরো অনেক কমে আসবে।
এমইউ/আরএস/পিআর