কক্সবাজার সামলাতে পারবে তো?

আদনান রহমান
আদনান রহমান আদনান রহমান , সায়ীদ আলমগীর সায়ীদ আলমগীর কক্সবাজার থেকে
প্রকাশিত: ১২:৪৪ পিএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭
ছবি : বিপ্লব দিক্ষিৎ

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমন নতুন নয়। সেই ১৭৮৪ সাল থেকে শুরু। ১৯৭৮ সালে বড় দাগে প্রায় দু-তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

১৯৯১-৯২ সালে মিয়ানমারের আধাসামরিক বাহিনী নাসাকা ও অন্যান্য বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে আরও প্রায় তিন-চার লাখ রোহিঙ্গা বংলাদেশে প্রবেশ করে। এরপর দীর্ঘ তিন দশকে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সর্বশেষ ‘শুদ্ধি অভিযান’র নামে ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে শুরু হয় সেনাবাহিনীর বর্বর দমন-নির্যাতন। দেশ ছাড়তে বাধ্য হন নিরীহ রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লাখের কাছাকাছি।

অন্যদিকে সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে কক্সবাজারের উখিয়ায় জনসংখ্যা ছিল দুই লাখ সাত হাজার ৩৭৯। এর মধ্যে এক লাখ দুই হাজার ৮১২ জন নারী এবং পুরুষের সংখ্যা নারীদের চেয়ে দুই হাজার বেশি। উখিয়ার ৫৪টি গ্রামে বসবাস করে প্রায় ৩৮ হাজার বাংলাদেশি পরিবার।

roh

বর্তমানে এ উপজেলায় স্থানীয়দের চেয়ে পাঁচ গুণের বেশি অনু্প্রবেশকারী রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।

২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ও বিদ্রোহী গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পুলিশ সদস্যসহ বহু রোহিঙ্গা হতাহত হন। ওই ঘটনার পর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি অভিযান’র নামে রাখাইন রাজ্যে নিরীহ মানুষের ওপর বর্বর নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘরে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটায়। জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশমুখী হন রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা চার লাখ ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে।

roh

স্থানীয়রা জানান, উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়লেও সেখানে স্কুল-কলেজ ও হাটবাজারের সংখ্যা বাড়েনি। ভোগ্যপণ্যের উৎপাদনও বাড়েনি। তবে বেড়েছে বাইরের মানুষের আনাগোনা, দ্বিগুণ হয়েছে উখিয়াবাসীর দৈনন্দিন খরচ। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে, তবে আতঙ্ক বেড়েছে টেকনাফ ও উখিয়াবাসীর। তাদের ‘মানবিক’ মনে ঘুরেফিরে কেবল একটাই প্রশ্ন, রোহিঙ্গাদের বাড়তি বোঝা একসময় উখিয়া থেকে কক্সবাজার শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়বে। তখন সে বোঝা কক্সবাজার সামলাতে পারবে তো? চায়ের দোকান থেকে হোটেল, গণপরিবহন- সর্বত্রই একই আলোচনা, একই গুঞ্জন।

উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মো. সালাউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়ায় খাবারের চাহিদা বেড়ে গেছে। পুরো এলাকায় ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে স্থানীয়দের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। নিত্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সেগুলোর সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

নিত্যপ্রয়োজনীর পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়ায় দামও নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে সামাজিক অস্থিরতাও তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

সরেজমিনে উখিয়া ও কক্সবাজারের কয়েকটি হোটেলে গিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগের মালিক ও কর্মচারী পুরনো রোহিঙ্গা। এমনকি বাংলাদেশে নতুন রোহিঙ্গাদের রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক, ত্রাণ সমন্বয়ক ও নিরাপত্তারক্ষীরাও পুরনো রোহিঙ্গা।

roh

উখিয়া বাজার থেকে ৫-৬ কিলোমিটার পর্যন্ত ইজিবাইক (টমটম), অটোরিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া দ্বিগুণ হয়েছে। আগে এখানে মাস হিসেবে হোটেল ভাড়া দেয়া হতো কিন্তু বর্তমানে অতিরিক্ত জনসমাগম ঘটায় দিন হিসাবে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে এবং ভাড়ার পরিমাণও কয়েক গুণ বেড়েছে।

পালংখালী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নুরুল আফসার চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, স্থানীয়দের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য রোহিঙ্গারা হুমকিস্বরূপ। কারণ আশ্রিতরা বালুখালী ও আশপাশের পাহাড়ে অবস্থান করছে। অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণের জন্য তারা সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে ফেলছে, পাহাড় কেটে ফেলছে। মানবিক কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। এ ধারা অব্যাহত থাকলে স্থানীয়দের আর্থসামাজিক অবস্থা চরম হুমকির মুখে পড়বে।

রাজপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। এরপরও মানবতার খাতিরে প্রধানমন্ত্রী তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছেন। এখন যে পরিমাণ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে তা টেকনাফ ও উখিয়ার স্থানীয়দের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। তাদের যত্রতত্র আবাস এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে স্থানীয়রা কোণঠাসা হয়ে পড়বেন।

‘রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেয়া এবং পরিচয় শনাক্তে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন চলছে। আমরা চাই সব রোহিঙ্গাকে নিবন্ধন করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হোক’- যোগ করেন তিনি।

roh

স্থানীয় একটি বোর্ডিংয়ের স্বত্তাধিকারী নাম প্রকাশ না করে বলেন, পুরাতন রোহিঙ্গারা দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে কক্সবাজারের প্রভাবশালীদের সঙ্গে মিলে এখন বাংলাদেশিদের মতো চলাফেরা করে, বাংলাদেশিদেরও নিয়ন্ত্রণ করে। ইয়াবা থেকে শুরু করে দেহ ব্যবসা- এমন কোনো জঘন্য কাজ নেই যা তাদের দ্বারা সংঘটিত হয় না।

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, নতুন আর পুরাতন রোহিঙ্গারা যদি এক হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তাহলে আমাদের কিছুই করার থাকবে না। এখনই তাদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে বলেও জোর দাবি জানান তিনি।

এদিকে, নতুন করে আগত রোহিঙ্গারা যাতে নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য সতর্ক দৃষ্টি রাখছে প্রশাসন। কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছেন পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরসহ আশপাশে এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। গাড়ি, সিএনজি থামিয়ে যাতায়াতকারীদের পরিচয় নিশ্চিত করা হচ্ছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত সুপার ও মুখপাত্র আফরুজুল হক টুটুল জাগো নিউজকে বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ ও এক জায়গায় রাখতে সরকার শেড তৈরি করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নজরদারি রাখছে। সবাইকে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আনলে তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও সহজ হবে।

এআর/এমএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।