‘দাদা এখানে মাইন পোঁতা আছে’

বিপ্লব দীক্ষিত বিপ্লব দীক্ষিত , স্টাফ ফটোগ্রাফার রাখাইনের তমব্রু (মিয়ানমার) থেকে ফিরে
প্রকাশিত: ০৬:৪৪ এএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭
ছবি : বিপ্লব দিক্ষিৎ

গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন আর ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে সেদেশের সেনাবাহিনী। এখনও আতঙ্ক কাটছে না মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে। এক মাসেও শেষ হয়নি সহিংসতা জ্বালাও-পোড়াও। বৃহস্পতিবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে তুমব্রু সীমান্তে অবস্থানরত কয়েকজন রোহিঙ্গার অনুরোধে সেই বর্বর চিত্রধারণের জন্য কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে ওপারে যাই।

সীমান্তের কাছাকাছি গিয়ে দেখতে পাই কাঁটাতারের বেড়া। আমার সঙ্গে থাকা অনলাইন পত্রিকার একজন রিপোর্টার আর দুই রোহিঙ্গা ছাড়া আশপাশে কাউকে দেখতে পেলাম না। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গিয়ে তাদের কাছ থেকে যা শুনেছি, ইচ্ছা হয়েছিল স্বচক্ষে এগুলো দেখি। তাই চলে গেলাম সরাসরি সীমান্ত এলাকায়।

rohinga

চোখের সামনে কাঁটাতারের বেড়া। খানিকটা ফাঁকা ছিল, মিয়ানমার দেখতে পাচ্ছিলাম। তখন চিন্তা করলাম ভেতরে যাব। সঙ্গে থাকা ল্যাপটপ ব্যাগটি নো-ম্যান্স ল্যান্ডে থাকা একজন রোহিঙ্গার কাছে দিয়ে বাংলাদেশ সীমানা পাড়ি দিয়ে আমরা মিয়ানমারে ঢুকলাম।

তখন একজন বললেন, ‘দাদা। এডে মাটির মইদ্দি বোম আসে। কালিয়া অ্যাড়ে মগ আর বিজিপি আইয়ারে, কি হরি গি। (দাদা মাটিতে মাইন পোঁতা আছে। গতকাল দেখলাম মগ এবং বর্ডার গার্ড পুলিশ-বিজিপি এসে এখানে কী যেন করে গেছে)।’

rohinga

তার কথা শুনে শিউরে উঠল শরীর। তবুও পিছপা হলাম না। আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলাম গ্রামের দিকে। আধা কিলোমিটার যাওয়ার পর চোখে পড়ল একটি জনশূন্য ঘর। ঘরের সামনে একটি মোটরসাইকেল, আরেকটু এগিয়ে একটি সেড দেখতে পাই। তার নিচে আরেকটি মোটরসাইকেল। এগুলোতে প্রচণ্ড পরিমাণ ধুলা ছিল। মোটরসাইকেলগুলোতে তেল ছিল কিন্তু লোক নেই। আরেকটু এগিয়ে দেখলাম গোলাভরা ধান। তখন ইচ্ছা জাগল বাড়ির ভেতরে ঢোকার। ভেতরে ঢুকেই দেখি ঘরের বেড়ার পার্টিসনের মাঝে ঝুলে আছে অনেক দিনের ধুলাবালি মাখা কাপড়-চোপড়। সঙ্গে দুটা পাটি। কাপড়গুলো দেখে বোঝা যাচ্ছিল সেদেশের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের সময় পরনের কাপড়েই পালিয়েছে রোহিঙ্গারা। আর কিছু নিতে পারেনি।

rohinga

সেখান থেকে বেরিয়ে হঠাৎ কয়েকজনের কথা বলার শব্দ পাই। মনে ভয় কাজ করছিল। আশপাশে কোনো লোক নেই কিন্তু শব্দ কিসের? তখন আমার সঙ্গে থাকা একজন রোহিঙ্গা মাঝি (দলনেতা) বলল, ‘ভাই ভয় পাবেন না। ওরা বাংলাদেশের নো-ম্যান্স এলাকায় থাকে। সেখানে পানি ও পায়খানার অভাবে ঝুঁকি নিয়ে আমাদের এখানে এসে স্নান (গোসল) করে। স্নান করে আবার চলে যায়।’

rohinga

কিছুক্ষণ পর আমরা এর পাশে একটি পাহাড়ের টিলায় যাই। চোখে পড়ল একটি মাটির ঘর। ভেতরে ঢুকে দেখি বিভিন্ন রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো। একজন বললেন, ঈদের দিন এই বাড়ির একজনের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। মাটিতে একটা পাটি এবং বিয়ের বিভিন্ন সরঞ্জাম ওইভাবেই পড়ে আছে। হয়তো বিয়ের অনুষ্ঠানের আগেই সেনাবাহিনী তাদের ধরে নিয়ে গেছে অথবা প্রাণ বাঁচাতে বাড়ির লোকজন বাংলাদেশে চলে গেছে।

rohinga

এ ঘর থেকে বের হওয়ার পর সামনে চোখে পড়ল সুন্দর একটি বাড়ি। বাড়ির জানালাগুলো ছিল বন্ধ, সামনে তালা ঝুলানো। তার পাশে একটি ঘরে মাটিতে রক্তমাখা কাপড়-চোপর পড়ে থাকতে দেখলাম। মাটিতে পড়েছিল পুড়ে যাওয়া একটি কোরআন শরিফ। শরীরটা আবারও শিউরে উঠল।

rohinga

এগিয়ে গিয়ে দেখলাম আরও দু-তিনটি ঘর। মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কী?’ মাঝি বললেন, ‘আস্তে কথা বলেন। এখানে মগ আর সেনাবাহিনীর সদস্যরা থাকেন। সামনে যাবেন না। গাছের আড়াল থেকে দেখেন।’

rohinga

সময় যখন বিকেল সাড়ে ৪টা, দূরে একটা গুলির শব্দ পেলাম। দেখলাম ধোঁয়াও উড়ছে। থেমে থেমে আবারও গুলির শব্দ। হঠাৎ দেখলাম অনেক আগুন। মাঝি বললেন, হয়তো কোনো রোহিঙ্গার বাড়ি পুড়ছে।

আমাদের সঙ্গে থাকা একজন রোহিঙ্গা বললেন, ‘ভাই ওরা মনে হয় আমাদের দেখে ফেলেছে।’ তখনই পাশ দিয়ে একটি গাড়ির শব্দ পাচ্ছিলাম। ভয় পেলাম, গাড়িতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কি না। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটি শ্যালো মেশিনের শব্দ। মাঝি বললেন, ‘ভাই আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না।’

rohinga

দুই গ্রাম পেরিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হলাম। হাঁটার সময় বুকটা ভয়ে কাঁপছিল। নিচে মাইন নেই তো। সামনের পাহাড়ের একটি জঙ্গল থেকে কয়েকজন রোহিঙ্গা পুরুষ আমাদের সামনে এলেন। কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। নিজেদের ভাষায় বললেন, ‘আরা এডে থাই। খারন হিয়ান আরার জন্মভূমি। ইয়ানল্লে বুলি আরা যান দিউম। (আমরা এখানে থাকি, কারণ এটা আমাদের জন্মভূমি। প্রয়োজনে জীবন দিতে প্রস্তুত আছি।)’

rohinga

আমরা আমাদের পরিচয় দিলাম। তারা আমাদের সঙ্গে আরও কিছু কথা বললেন। বললেন, ‘সামনে অনেক জায়গায় মাইন পোঁতা আছে। মগরাও চলে আসতে পারে। আমরা যেদিক দিয়ে বলি সেখান দিয়ে যান।’

rohinga

পাহাড়ের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার সহজ একটি পথ দেখিয়ে দিল। পথ ধরে প্রায় ৩০ মিনিট হাঁটছি। মাইনের আতঙ্কে ৩০ মিনিট যেন ৩ ঘণ্টার মতো মনে হচ্ছিল। অবশেষে দেখতে পেলাম বাংলাদেশের সীমানা। মনের ভেতর কিছুটা স্বস্তি কাজ করছিল। কতক্ষণে বের হব সেই চিন্তা করছিলাম। কিন্তু আমরা যে সীমান্ত দিয়ে ঢুকেছি সেটি এটা ছিল না। তখন পাশের জনকে বলছিলাম, আগে মিয়ানমার থেকে বের হই। ওপারে গিয়ে আমাদের সীমান্ত খুঁজব।

rohinga

বের হলাম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল যদি না ফিরতে পারতাম? নিজ মাতৃভূমিতে ঢুকে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস নিলাম। কিছুক্ষণ হেঁটে আমাদের সীমান্ত খুঁজে পেলাম। নো-ম্যান্স ল্যান্ডে গিয়ে আমাদের ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়ে ফিরে এলাম উখিয়ার দিকে।

এআর/বিএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।