অনাগত সন্তানই তাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন
মঙ্গলবার বিকেল, পশ্চিম আকাশে সূর্য অনেকটা ঢলে পড়েছে। আকাশে নীল-সাদায় মাখামাখি। উখিয়া-টেকনাফ সড়কে চলাচল করছে শ’য়ে শ’য়ে যানবাহন। এমন সময় দেখা হয় সেবু তারা’র সঙ্গে। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর নিয়ে কাপড়ের পুটলিতে মাথা রেখে রাস্তার ধারে শুয়ে আছেন তিনি।
ক্যামেরা দেখে বসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। ক্লান্ত শরীরে যেন এক বিন্দু শক্তিও অবশিষ্ট নেই।
বয়স মাত্র ১৭। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মংডুর পাড়িয়াবিল এলাকায়। চারদিন হেঁটে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন তিনদিন হলো। পথে খাবার জোটেনি। বার্মিজ সেনার বুলেট থেকে কোনোরকম প্রাণে বেঁচে বাংলাদেশে আশ্রয় হলেও মৃত্যু যেন এখনও তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
এখনও আশ্রয় মেলেনি। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, সব ঝঞ্জাই বয়ে গেছে সেবু তারার ওপর দিয়ে। আশ্রয় নেই, খাবার নেই, বেঁচে থাকার ইচ্ছাও হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু যখনই অনুভব করেন গর্ভে বেড়ে উঠছে প্রাণপ্রিয় সন্তান, তখনই নতুন করে স্বপ্ন দেখেন ‘আসছে নতুন শিশু, তাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে’।
মঙ্গলবার সকালে স্বামী মোহাম্মদ ইলিয়াস তাকে নিয়ে বের হন আশ্রয়ের খোঁজে। দুপুর পর্যন্ত হাঁটার পর পা আর চলছিল না। শরীর ভেঙে আসছিল। উপায় না পেয়ে রাস্তার ধারে শুয়ে পড়েন সেবু। কিন্তু আশ্রয় তো খুঁজে বের করতেই হবে। না হলে বৃষ্টি-ঝড়ের দুর্ভোগে ফের পড়তে হবে। সেবুকে রেখেই আশ্রয়ের সন্ধানে ছোটেন স্বামী।
কথা হয় সেবু তারার সঙ্গে। জানান, মংডুর যে এলাকায় তাদের বাড়ি সেখানে গত ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরে নির্বিচারে আগুন জ্বালিয়ে সবকিছু জ্বালিয়ে দেয় মিয়ানমারের সেনারা। চোখের সামনেই বাড়ি পুড়ে ছাই হতে দেখেছেন তিনি। সহায় সম্পদ লুট করে নেয় সেনাদের সঙ্গে আসা স্থানীয় মগ’রা। শ্বশুরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওইদিনই বিকেলে স্বামীর হাত ধরে অজানার পথে পা বাড়ান সেবু। সঙ্গে ছিল গ্রামের আরও জনা ত্রিশেক লোক। যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
কিছু দূর হেঁটে অদূরের একটি পাহাড়ে আশ্রয় নেন সবাই। রাতে সেখানে সেনারা আবার হানা দেয়। নির্বিচারে গুলি চালায়। সেবুর ভাই ইয়াসিদুলসহ চারজন মারা যান। তাদের ‘দাফন’ না করেই ভোররাতে আবার বাংলাদেশের দিকে এগোতে থাকেন। এরপর টানা চারদিন মাইলের পর মাইল ফসলের মাঠ, পাহাড়, জঙ্গল, নদী পার হয়ে গত ১৫ সেপ্টেম্বর ভোরে হোয়াইকং সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন সবাই।
গত তিনদিনের টানা বৃষ্টি ও বজ্রপাতের মাঝে অভুক্ত অবস্থায় দিনযাপন করতে হয়। এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়- এমন প্রশ্ন রেখে সেবু তারা বলেন, ‘গর্ভের সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সব কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছি।’
সেবু তারার মতো এমন অসংখ্য অন্তঃসত্ত্বা নারী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। পেটে সন্তান নিয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের।
স্বাস্থ্য অধিদফতর ও কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ৫৪ হাজার গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মা চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৭ হাজার নারীই অন্তঃসত্ত্বা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যাটারনাল, নিউনেটাল, চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলোসেন্স হেলথ প্রকল্পের পরিচালক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, আগত রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা, স্তন্যদায়ী মা ও শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। তাদের শরীরে পুষ্টি নেই, খাবার নেই, তারা শিশুদের খাওয়ানোর মতো পুষ্টি পাবে কোথায়?
কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. শেখ আব্দুস সালাম বুধবার সন্ধ্যায় জাগো নিউজকে বলেন, কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে অবস্থানরত ১৭ হাজার অন্তঃসত্ত্বা রোহিঙ্গা নারী তাদের তত্ত্বাবধানে আছেন। তাদের সব ধরনের চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, যেকোনো ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলায় হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা আরও বাড়ানো হয়েছে। তাদের নিরাপদে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রসব সংক্রান্ত যেকোনো জটিলতা হলে রোগীকে বিনা খরচে অ্যাম্বুলেন্সে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।
‘তবে জরুরি ভিত্তিতে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যদিও এখন শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেয়া গর্ভবতী নারী, দুগ্ধপোষ্য শিশু, সাবালক কিংবা পুরুষ সবার জন্য রান্না করা খিচুড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। গর্ভবতী নারী ও কোলের শিশুদের জন্য দ্রুত তাদের উপযোগী খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে’- যোগ করেন তিনি।
পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের বেশি আমিষ দরকার। প্রতিদিন তাদের ৯০ থেকে ১০০ গ্রাম আমিষের প্রয়োজন। এর মূল উৎস হলো- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, বাদাম, ডাল ও সিমের বিচি। এছাড়া লৌহ ও ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন সমান মাত্রায়। স্বাভাবিক অবস্থায় যেখানে একজন পূর্ণবয়স্ক নারীর দৈনিক ৩০ গ্রাম লৌহ বা আয়রন দরকার, সেখানে গর্ভকালীন সময়ে দরকার হয় দৈনিক ৩৮ গ্রাম।
গর্ভবতী রোহিঙ্গা মায়েদের জন্য যতদ্রুত সম্ভব পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা মায়েরা যাতে নতুন করে গর্ভবতী না হন সেদিকেও জোর দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. শেখ আব্দুস সালাম আরও বলেন, গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত তারা ২০০টি ডেলিভারি সম্পন্ন করেছেন। মা ও সন্তান উভয়ই ভালো আছেন। তবে তাদের পুষ্টির অভাব রয়েছে।
তিনি বলেন, রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কক্সবাজার সদর, উপজেলা ও ইউনিয়ন হেলথ কমপ্লেক্সে সবমিলে ১৩ হাজার রোহিঙ্গা নারী ও শিশুকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোগী আহত, গুলিবিদ্ধ ও ধারাল অস্ত্রের আঘাতে যখম হওয়া। তাদের যথার্থ চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া দীর্ঘ কর্দমাক্ত পথ হেঁটে আসায় তাদের পা ফুলে গেছে এবং ঘা হয়েছে। অনেকের শরীরে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগও দেখা দিয়েছে। আমরা সবাইকে চিকিৎসা দিচ্ছি। একজন এইচআইভি পজেটিভ পুরুষও শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে দুই লাখ ৯৯ হাজার ৯৫৬ জনের পুষ্টি সহায়তা প্রয়োজন। এর মধ্যে পাঁচ বছরের নিচে শিশুর সংখ্যা এক লাখ ৫৪ হাজার। এছাড়া, পুষ্টি সহায়তা দরকার এমন ৯১ হাজার ৫৫৬ জন কিশোরী ও রোহিঙ্গা নারীর মধ্যে ৫৪ হাজার ৬৩৩ জন অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদায়ী মা রয়েছেন।
এআর/এমএআর/এমএস