শৃঙ্খলা ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ

আদনান রহমান
আদনান রহমান আদনান রহমান , নিজস্ব প্রতিবেদক উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে
প্রকাশিত: ০৫:১৭ পিএম, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মূষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এরই মধ্যে সামান্য ত্রাণের আশায় কাঁধে শিশুসন্তান নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু অবস্থা এক রোহিঙ্গা মায়ের। ত্রাণভর্তি একটি ট্রাক এসে থেমেছে বালুখালির শরণার্থী শিবিরের সামনে। ওই ট্রাক ঘিরেই শত শত রোহিঙ্গার জটলা।

বৃষ্টিতে ভিজে কাদামাটি মাড়িয়ে শত শত রোহিঙ্গা যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু, একটি মাত্র চাওয়া যদি কিছু সাহায্য পাওয়া যায়। যদি সামান্য খাদ্য, ত্রিপল, শুষ্ক কাপড় ভাগ্যে জোটে। স্থানীয় বাংলাদেশিদের উদ্যোগে দেয়া এসব ত্রাণসামগ্রী বিতরণে সর্বত্র বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। কেউ পাচ্ছেন, আবার কেউ পাচ্ছেন না। কেউ বা একাধিক খাবারের প্যাকেট পাচ্ছেন আর যারা দুর্বল প্রকৃতির তাদের ভাগ্যে কিছুই জুটছে না। গত রোববারের চিত্র এমনই।

কাঁধে দুই বছরের শিশুসন্তান মিনারাকে নিয়ে কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী বালুখালির একটি শরণার্থী শিবিরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আফিয়া বেগম। বৃষ্টিতে ভিজে জীর্ণ অবস্থা মা ও শিশুসন্তানের। নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণপ্রিয় স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা হতে দেখেছেন।

শুধু আফিয়া নন, ওই শিবিরে আশ্রয় হয়েছে শিশুসন্তানসহ শত শত রোহিঙ্গা নারীর। সবারই অবস্থা একই। জরুরি ভিত্তিতে তাদের খাবার ও বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন।

মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার লামবাগুনা গ্রামে স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ছিল আফিয়ার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, একেবারে নিঃস্ব হয়ে কোনোরকম প্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি। শরণার্থী শিবিরে দু’দিন হলো আশ্রয় নিয়েছি।

rohinga

‘এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাইনি। কোনো খাবার নেই, মাথাগোঁজার ঠাঁইও নেই।’

তিনি বলেন, শিশুসন্তান নিয়ে ধাক্কাধাক্কি দিয়ে ত্রাণ নিতে পারছি না। দয়া করে কেউ কিছু দিলে তা নিয়েই দুই সন্তান নিয়ে দিনপার করতে হচ্ছে। ‘কেউ কিছু দিলে খাই, অন্যথায় সারাদিন উপোস থাকি’- বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন আফিয়া।

অপর এক রোহিঙ্গা তার ত্রিপলে আফেয়া ও তার দুই সন্তানকে আশ্রয় দিয়েছেন। সেখানেই কোনো রকম রাত কাটান তারা। ‘আমি এমনই ভাগ্যহত, এখন পর্যন্ত কোনো ত্রিপল জোগাড় করতে পারিনি।’

টেকনাফ থেকে জাগো নিউজের প্রতিনিধি জানান, এখনও সেভাবে ত্রাণ বিতরণে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। টেকনাফ সড়কের দু’পাশে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছেন৷ ত্রাণের কোনো গাড়ি দেখলেই তারা ছুটে যাচ্ছেন৷ প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কির কারণে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে৷

ত্রাণের ক্ষেত্রে কার কী প্রয়োজন তার কোনো হিসাব নাই৷ সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন সংস্থা তাদের ইচ্ছামতো ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন৷ যত্রতত্র তারা সেগুলো বিলি করছেন। কোনো শৃঙ্খলা না থাকায় কেউ কেউ পর্যাপ্ত ত্রাণ পা্চ্ছেন আবার কারও ভাগ্যে কোনো কিছুই জুটছে না।

rohinga

সরেজমিন শিবিরগুলো ঘুরে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি কষ্টের মধ্যে আছে শিশুরা। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের অবস্থাও সঙ্কাটাপন্ন৷ তাদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না৷

স্যানিটেশন ও খাবার পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। মাত্র ৩০টি নলকূপ দিয়ে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে৷

আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলে জাগো নিউজ’কে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মাহিদুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একস্থানে নিয়ে ত্রাণ সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করছি। এজন্য আমরা ১২টি স্পট নির্ধারণ করে দিয়েছি। জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ওই ১২টি স্পটে ত্রাণ বিতরণ করা যাবে।

তিনি আরও বলেন, আগে বিশৃঙ্খলাভাবে ত্রাণ দেয়া হতো। এখন একটা সিস্টেমের মধ্যে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আমরা একটি কন্ট্রোল সেন্টার খুলেছি। ত্রাণ নিয়ে কোনো গাড়ি এলে আমরা ওই কন্ট্রোল সেন্টারের মাধ্যমে ত্রাণ দেয়ার স্পট জানিয়ে দিচ্ছি। ওই স্পটে গাড়ি যাওয়ার পর সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা ত্রাণগুলো নিয়ে তা বিতরণের ব্যবস্থা করছেন।

‘১২টি স্পটের প্রতিটিতে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আছেন। এছাড়া বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা আছেন। তাদের সমন্বয়ে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। আশা করি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আমরা একটি সুশৃঙ্খল পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারব’- যোগ করেন তিনি।

rohinga

রোহিঙ্গাদের বালুখালিতে নেয়ার চেষ্টা

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, কুতুপালংয়ের কাছে বালুখালি এলাকায় সব শরণার্থীকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে। দুটি নিবন্ধিত ও ১৪টি অনিবন্ধিত ক্যাম্প ছাড়াও টেকনাফ, উখিয়া এলাকায় রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন৷ ত্রাণের আশায়ই মূলত তারা মহাসড়কে পাশে অপেক্ষা করছেন৷ তাদের জন্য থাকার প্রকৃতপক্ষে এখনও কোনো ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি।

রোহিঙ্গাদের বালুখালিতে স্থানান্তরের বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মাহিদুর রহমান বলেন, আমরা চেষ্টা করছি রোহিঙ্গাদের বালুখালিতে স্থানান্তর করতে। সেখানে চার লাখের অধিক রোহিঙ্গাকে রাখা সম্ভব হবে।

‘বালুখালির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য আমরা তিনটি পথ তৈরি করছি। ইতোমধ্যে একটির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে পারলে আশা করি একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আমরা আসতে পারব।’

সম্প্রতি বালুখালিতে ত্রাণ বিতরণের সময় দুই শিশু ও এক মহিলার মৃত্যু বিষয়ে মাহিদুর রহমান বলেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। যত্রতত্র ত্রাণ বিতরণের কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর না ঘটে সে জন্য সরকারি ও বেসরকারি সকল সহযোগী সংস্থার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু একটি ব্যবস্থাপনার মধ্যে আমরা এসেছি।

জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন খাবার শেল্টার আর স্যানিটেশন

কক্সবাজার জেলার সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালাম সোমবার রাত ১০টায় জাগো নিউজ’কে বলেন, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের এখন জরুরি ভিত্তিতে তিনটি জিনিস প্রয়োজন। সেগুলো হলো- খাবার, শেল্টার আর স্যানিটেশন।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ক্যাম্প এলাকায় পর্যায়ক্রমে ৩৬টি মেডিকেল টিম কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা ৩০ হাজার শিশুকে বিভিন্ন ধরনের রোগ প্রতিরোধক ভ্যাকসিন দিয়েছি। ১৫ থেকে ১৬ হাজার অন্তঃসত্ত্বা নারীকে আমরা চিহ্নিত করেছি এবং তাদের নিরাপদ প্রসবের বিষয়টি নিশ্চিত করেছি।

rohinga

‘শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে৷ একজন এইচআইভি পজেটিভ পুরুষও পেয়েছি৷ ডায়রিয়া, নিউমোনিয়সহ নানা ধরনের রোগে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে৷ তাদের পুষ্টির অভাব রয়েছে। একটু আগেও বৃষ্টি হয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে আশ্রিতদের বিশুদ্ধ খাবার, পানি, শেল্টার ও সুষ্ঠু স্যানিটেশন ব্যবস্থার প্রয়োজন’- যোগ করেন তিনি।

ডা. আব্দুস সালাম বলেন, এখন পর্যন্ত অপুষ্টির কারণে কোনো মা ও শিশু মারা যায়নি। একটি শিশু মারা গেছে শ্বাসতন্ত্রের জটিলতার কারণে।

জাতিসংঘের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২৫ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে মোট চার লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছেন৷ তাদের মধ্যে শিশু দুই লাখ ৪০ হাজার, এক বছরের কম বয়সি শিশু ৩৬ হাজার, অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতি নারী ৫২ হাজার৷

জাতিসংঘ থেকে জরুরি সহায়তা চাওয়া হয়েছে সাত কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার৷ বাংলাদেশ সরকার, বিদেশি রাষ্ট্র, ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক ত্রাণ সহায়তা চলছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে৷

এআর/এমএআর/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।