ওরা আর হাসবে না?
‘সেনারা বোমা মেরে বাড়ি উড়িয়ে দিয়েছে। বোমা মারা আগেই আমরা বাড়ি থেকে পালিয়ে ক্ষেতে বসে ছিলাম। পরে রাত হলে সবাইকে নিয়ে রওনা দিই। দু’দিন হাঁটার পর বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে টেকনাফে আসি। নৌকা থেকে নামার পর হুড়াহুড়ি শুরু হয়। এরপর আর ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছি না। পানিতে ডুবে গেল নাকি অন্যদিকে দৌঁড় দিল, টের পেলাম না। সবাই ফিরলাম। ছেলেকে পেলাম না।’
বাড়িঘর তো হারিয়েছেন, সেটার চেয়ে ১০ বছরের ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর প্রায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা শামসুল আলম। বয়স ত্রিশের কোটা পার হয়েছে। শামসুলের বৃদ্ধ মা নাতিকে হারিয়ে বুক চাপড়াচ্ছেন। আর ছেলে হারানো মা (শামসুলের স্ত্রী) নির্বাক হয়ে মাটিতে বসে আছেন। কোলে এক মাসের ছেলে।
প্রসূতি এই মায়ের দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও নেই। কাদা মাটিতে বসেই হারানো ছেলের জন্য অঝোরে অশ্রু ঝরাচ্ছেন। পরিবারের ছোট-বড় আরও ৯ সদসের সবারই চোখ অশ্রুভেজা।
লাখ লাখ রোহিঙ্গার চোখের এমন লোনা জলে ভাসছে সাগর পাড় কক্সবাজার। গোটা কক্সবাজারই এখন রোহিঙ্গা শিবির। উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে তিল ধরার ঠাঁই নেই। সর্বহারা মানুষের ঠিকানা কক্সবাজার-বান্দরবান।
দেশটির সেনাবাহিনী নিপীড়নে সব হারিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গারা বলছেন, গুলি করে মারছে সেনাবাহিনী এবং জবাই আর পুড়িয়ে মারছে বৌদ্ধারা। সেনারা বোম মারছে, বৌদ্ধরা ছুঁড়ছে তীর। এ ছাড়া বৌদ্ধ মগদের ছোঁড়া বারুদমাখা তীরে গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছারখার হচ্ছে।
জাতিসত্তার এই হিংসার তীরে বিদ্ধ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের অন্তরও। বিষমাখা তীরে কেড়ে নিয়েছে রোহিঙ্গাদের হাসি। ওরা আর হাসে না। শেষ কবে হেসেছিল তাও জানে না। জানে না আর কখনও হাসবে কি না?
রোহিঙ্গাদের বাঁচাতে হাজারও হাত এখন কক্সবাজারে। দেশি-বিদেশি সংগঠনের পাশাপাশি ব্যক্তি মানুষেরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে দিয়েছেন। জাতি, ধর্ম ভুলে মানবতার ছাঁয়ার পরশে ভালোবাসা মিলছে। এত ভালোবাসা! তবুও হাসি নাই রোহিঙ্গাদের মনে। দেশত্যাগের বেদনা বুঝি হাসি চিরতরে কেড়ে নেয়?
বুধবার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রাস্তার পাশে লাঠিতে ভর করে বসে ছিলেন বৃদ্ধা সাবেদা খাতুন। ২০১৫ সালের সহিংসতায় একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন এ বৃদ্ধা। এবারে বাড়ি জ্বলছে। ছেলের বিধবা বউ আর দুই নাতনিকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন গতকাল। বলেন, ‘আমার হাসি তো উড়ে গেছে সেই ২০১৫ সালেই। ছেলেহারা বেদনা আর চোখের জলই আমার সম্বল।’
উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা রাখাইনে কয়েকটি পুলিশ চেক পোস্টে হামলা চালায়। এতে নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য নিহত হন। এরপরই শুরু হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংশ অভিযান। ওই অভিযান শুরুর পর জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে।
রাখাইনে সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকড়ি থাকায় নির্মম এ নির্যাতনের খবর মূলত পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, সেখানে হত্যা, ধর্ষণসহ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তাদের ঘরবাড়ি।
এএসএস/আরএস/আরআইপি