বাবার পোড়া মরদেহ, এখনও আঁতকে ওঠে শিশু তাকের
বাবার পোড়া মরদেহ দেখে আঁতকে উঠেছিল ১১ বছরের শিশু মোহাম্মদ তাকের। সেই দুর্বিষহ স্মৃতি এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। বাবার দগ্ধ মরদেহ রেখে কোনো রকম জীবন নিয়ে সীমানা পার হয়ে বালুখালী শিবিরে অবস্থান নিয়েছে রোহিঙ্গা এ শিশু। মা আর চার ভাইবোনকে নিয়ে এখন চলছে তার বেঁচে থাকার লড়াই।
তাকেরের বাড়ি আরাকান প্রদেশের রাসিডং উপজেলার শিলকালি গ্রামে। পাহাড়-জঙ্গলের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে সীমান্তে আসতেই দু’দিন পার। অবশেষে বহু কষ্টে নাফ নদী পার হয়ে অসহায় মা আর চার ভাইবোন নিয়ে টেকনাফে আসা।
রোহিঙ্গা শিশু তাকের
ঈদের পরপরই মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাকেরের শিলকালি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। জ্বালিয়ে দেয়া হয় তাদের বাড়িঘর। সঙ্গে প্রিয় বাবাকে জীবন্ত দাহ করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তাদের সঙ্গ দেয় স্থানীয় মগ সন্ত্রাসীরা।
রোববার দুপুরে বালুখালী শিবিরে অসহায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে পাশে এসে দাঁড়ায় তাকের। একই গ্রামের অপর এক রোহিঙ্গা তাকেরকে দেখিয়ে বলেন, ‘সেনারা ওর বাবাকে পুড়িয়ে মেরেছে।’
বাবার কথা শুনেই নোনা জলে চোখ যেন ভেসে যায় শিশু তাকেরের। চোখের পাতা ফুলে গেছে। রাত জাগা আর স্বজন হারানো বেদনা যেন তার চোখের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। সকালে এক মুঠো পান্তা জুটেছিল। অন্য চার ভাইবোনের খাবার জুটলেও মায়ের ভাগ্যে জোটেনি। ক্ষুধার্ত মা পলিথিনের নিচে শুয়ে আছে, আঙুল উঁচিয়ে অভাগা মাকে দেখাল তাকের।
দুপুরে কেউ ত্রাণ দিতে এলে মায়ের জন্য খাবার নিয়ে যাবে। বাম হাতের কোনায় বিষফোঁড়া উঠেছে বলে ত্রাণের জন্য দৌড়াদৌড়িও করতে পারছে না। কাঠফাটা জ্বর শরীরজুড়ে। নিথর শরীরে চাতকের বেশে চেয়ে আছে সামান্য খাবার-সাহায্যের জন্য।
ঈদের পর কোনোদিন গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, তা মনে নেই তাকেরের। দু’দিন হলো বালুখালী এসেছে, শুধু এটুকুই মনে আছে তার। আর মনে আছে বাবার পোড়ানো মরদেহের তিক্ত স্মৃতি। চোখের সামনে প্রিয় বাবাকে পুড়ে অঙ্গার হতে দেখেছে সে। বীভৎস সেই ছবি কোমল হৃদয়ে যেন রক্তাক্ত আঁচড় কেটে দিয়েছে।
বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিশুরা
শুধু সে একা নয়, বাবাকে চোখের সামনে জ্বলেপুড়ে ছাই হতে দেখেছে মা ও অন্যান্য ভাইবোনরা। বাবাকে বাঁচাতে কিছুই করার ছিল না ওদের। এমনকি চিৎকার করে কান্নাও করতে পারেনি। দূর থেকে দাঁড়িয়ে নীরবে শুধু অশ্রু বিসর্জন করতে হয়েছে তাদের।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তাকের বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। থেমে থেমে সে বলে, সন্ধ্যার আগে বাড়িতে হামলা করে সেনারা। প্রথমে আমাদের মারপিট করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এরপর গরু-ছাগলসহ সবকিছু লুট করা হয়। সবকিছু আমরা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।
‘এরই মধ্যে বাবা আবুল হোসেনকে বেঁধে ফেলা হয়’- বাবার কথা বলতেই থমকে যায় সে। কষ্ট, বেদনা, ঘৃণা ও ক্ষোভ যেন সারা মুখজুড়ে। অজান্তেই দু’ফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।
খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটে ভুগছে রোহিঙ্গা শিশুরা
তাকের চোখ মুছে খানিক সংযত হয়ে ফের বলতে শুরু করে। ‘বাবাকে গাছের সঙ্গে প্রথমে বেঁধে ফেলে ওরা। এরপর হাত-পা কেটে ফেলা হয়। বাবা খুবই চিৎকার করছিল। আমরা দেখলেও ভয়ে কান্না করতে পারছিলাম না। কান্না শুনলে ওরা আমাদেরও ধরে মেরে ফেলত।’
‘খানিক পর বাবার চিৎকার থেমে যায়। এরপর কেরোসিন ঢেলে বাবার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।’ এতটুকু বলেই থেমে যায় তাকের। কিছুক্ষণ আকাশপানে তাকিয়ে থাকে। হয়তো শূন্য আকাশে বাবাকে খোঁজার চেষ্টা।
বুঝলাম, ওর (তাকের) ভেতরের কান্না আর বাইরে আসবে না। নিজ দেশেই যখন কাঁদতে পারেনি, তখন ভিনদেশে কেঁদে কী লাভ!
সব হারিয়ে শিশুসন্তান নিয়ে বালুখালী শিবিরে আশ্রয় নেয়া এক রোহিঙ্গা নারী
প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট রাতে রাখাইনে একসঙ্গে ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনাক্যাম্পে হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরএসএ)। ওই হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্যসহ ৮৯ জন মারা যায় বলে মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য। এরপরই রাজ্যটিতে শুরু হয় সেনা অভিযান।
জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেনা অভিযানে এক হাজারের অধিক নিরীহ রোহিঙ্গা মারা গেছে। আর প্রাণ বাঁচাতে সর্বস্ব হারিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা। যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
এএসএস/এমএআর/আরআইপি