শুধুই কি বাংলাদেশের ব্র্যান্ড

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:৩২ এএম, ০৯ জুন ২০১৫

সালমা খাতুন কোথাকার? প্রশ্নটা শুনে অনেকেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতে পারেন! কেউ ভ্রূ কোঁচকাতে পারেন এই বলে; এটা কোনো প্রশ্ন হলো! কেউ আবার হাসতে হাসতে বলতে পারেন; কেন খুলনার? কিন্তু সালমা খাতুন নিজে কি বলেন? তাঁর উত্তর: ‘আই অ্যাম মেড ইন বাংলাদেশ।’

হ্যাঁ, সালমার কথাটা অবশ্য বিজ্ঞাপণের ভাষা। ঢাকার রাজপথের অনেক মোড়ে দেখতে পাবেন সালমার ঐ বিজ্ঞাপনের বোর্ড। বিজ্ঞাপনের ভাষা শুধুই চটকদার, অনেকে আবার এরকম করেও ভাবেন। ভাবনা-চিন্তার স্বাধীনতা অবশ্য প্রত্যেকেরই আছে। যে যার মতো করে ভাবতেই পারেন। ভাবলে তাঁকে দোষ দেয়া যাবে না। কিন্তু তারপরও একটা কথা বলতেই হচ্ছে; সালমা খাতুন শুধুই বিজ্ঞাপনের মডেল নন। তিনি ব্র্যান্ডও বটে। আর সেই ব্র্যান্ডটা হচ্ছে- বাংলাদেশ ক্রিকেটের। যে ব্র্যান্ডে আপাত যতোটা মুগ্ধ তারচেয়ে বেশি বিস্মিত ক্রিকেট বিশ্ব

না; একটু ভুল বলা হলো। শুধু ক্রিকেট বিশ্ব বলছি কেন? বলা যেতে পারে গোটা বিশ্ব। তাই যদি না হবে তাহলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে তাঁর শেষ বক্তৃতায় কেন সালমার বিজ্ঞাপনের বিল বোর্ড দেখে নিজের মুগ্ধতার কথা বলবেন? কেউ বলছেন, এটা হচ্ছে পি আর এজেন্সি নির্ভর মোদির বক্তৃতা। যে কারণে তিনি এটা বলতে পারেন। কেউ বলছেন; ক্রিকেটও যে কূটনীতির অংশ হতে পারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তা আরো একবার বুঝিয়ে দিলেন। আবার কেউ বলছেন এটাই হচ্ছে রিয়াল মোদি। যিনি ক্রিকেট ভালোবাসেন।
এটুকু পড়ে আবার কারো মনে হতে পারে, মোদির স্তূতি করতে বোধহয় এই লেখা! তাদের জন্য অবশ্য একটা বাক্য লিখতেই হচ্ছে, কারো স্তূতিকাব্য লেখা  কোনো সাংবাদিকের কাজ নয়। সত্যকে খোঁজার চেষ্টাই লেখকের উদ্দেশ্য। সে কারণে বলতেই হচ্ছে সালমা খাতুন সত্যিই ব্র্যান্ড। এবং বিশ্বকে বিস্মিত করে দেয়ার মতোই ব্র্যান্ড। আর সেটা খুব ভাল করেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন নরেন্দ্র মোদি। কারণ, তিনি রাজনীতিবিদ। তিনি ক্রিকেটপ্রেমী। এবং সাবেক ক্রিকেট প্রশাসক।

সালমা খাতুন  সিম্বল। তবে শুধু বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটের নয়। বাংলাদেশে নারীর এগিয়ে চলার মডেলও বটে। অবশ্য নারী সমঅধিকারের কথা বলে যারা নিজেদের স্বার্থে রাজপথ কাঁপিয়ে বেড়ান, গোল টেবিল বৈঠকে কথার ঝড় তোলেন কিংবা টেলিভিশন টক শো-তে বড় বড় কথা বলে  নিজেদের নারীবাদী প্রমাণের চেষ্টা করেন  সালমা খাতুন সেই দলের নন। আবার সালমা খাতুন সেই দলেরও নন, যারা নিছক রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে গলা ফাটিয়ে বলে বেড়ান; নারীর ক্ষমতায়নের রোল মডেল হচ্ছে বাংলাদেশ! যে দেশে প্রধানমন্ত্রী নারী। বিরোধী দলীয় নেতা নারী। জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসনও নারী। বাংলাদেশে নারীদের জয়জয়কার। হ্যাঁ, সালমা খাতুন সত্যিই এদের কোনো দলেই পড়েন না। কারণ; সালমা সেই নারী যারা প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ থেকে উঠে এসে আজ আলোর পথযাত্রী। সালমা সেই নারী যারা (দু)সাহস দেখিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে খেলার মাঠে নেমেছেন! সাালমা সেই নারী যারা কোনোরকম উত্তরাধিকার সূত্রে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাননি। পেয়েছেন নিজের সাহস, শ্রম, মেধা আর যোগ্যতায়। সে কারণেই সালমা ব্র্যান্ড। এবং তিনি বাংলাদেশের ব্র্যান্ড।

নরেন্দ্র মোদির কথায় বার বার উঠে এসেছে ‘বিকাশ’ শব্দটা। মোদির সেই বিকাশ শব্দটাও যথার্থ মনে হবে সালমাদের ক্ষেত্রে। সালমা বাংলাদেশের বিকাশমান নারী সমাজের প্রতিনিধি। আজকের বাংলাদেশেও সেই মানুষের অভাব নেই যারা নারীকে চার দেয়ালে আটকে রাখার মাঝেই নারীর সামাজিক এবং পারিবারিক নিরাপত্তা খুঁজে পান! সালমা-রা সেই ভ্রান্তধারণা বিদীর্ণ সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পেরেছেন। আবার পুরোপুরি পারেননি সমাজ আর প্রশাসনে পুরুষের অধিক ক্ষমতায়নের কারণে।

নরেন্দ্র মোদি যখন সালমা খাতুনকে বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে চলার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরলেন, তার কয়েক ঘন্টা আগে সেই সালমা খাতুনকে মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হয়েছে; নারী ক্রিকেটারদের খাবার মান ঠিক নেই তাই তাঁদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে! আগে যে নারী ক্রিকেটাররা খাবারের জন্য সাড়ে সাতশ টাকা পেয়ে খুশি ছিলেন, তাদের মধ্যে কেন খাবার নিয়ে  অসন্তোষ! এই প্রশ্নের উত্তর যিনি সবচেয়ে ভাল দিতে পারতেন, বিসিবি-র মহিলা উইং এর দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই পরিচালকের মোবাইল বেজেই গেছে কিন্তু গণমাধ্যম কর্মীরা তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া জানতে পারেননি! বিসিবির মহিলা উইং দেখভালের জন্য কি এখন বাংলাদেশে একজন মহিলা ক্রিকেট সংগঠক খুঁজে পাওয়া যাবে না! বাংলাদেশে নারী ক্রিকেটের উত্তরণের সময়ওতো একজন নারী সংগঠকই দায়িত্বে ছিলেন। জাতীয় ক্রীড়াপরিষদের কোটায় এখনো বিসিবির একজন পরিচালকের পদ শুন্য। একজন যোগ্য নারী ক্রীড়া সংগঠক কি সেখানে আসতে পারেন না? যদি না পারেন, তাহলে বলতে হবে সালমা-রা পারেন। আবার পারেন না! অথবা তাঁদের পারতে দেয়া হয় না।

শুরুর প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে লেখার শেষেও! সালমা কোথাকার? সালমা আসলে খুলনার নন, বাংলাদেশের নন। সালমা সেই সমাজের, যে সমাজ বিকাশমান কিন্তু পুরোপুরি বিকশিত হতে পারছে না। সালমা সেই রাষ্ট্রের বছর দশেক আগেও যে রাষ্ট্রে নারীদের ফুটবল খেলতে দেয়া হবে না বলে হুমকি দিয়ে রাজপথে মিছিল হয়েছে! সালমা সেই রাষ্ট্রের যে রাষ্ট্রে ফুটবল খেলতে এসে নরেন্দ্র মোদির ভারতের পশ্চিমবঙ্গ নারী ফুটবল দলকে না খেলেই দেশে ফিরতে হয়েছিল! আবার সালমা সেই সমাজ, সেই রাষ্ট্রের যারা একের পর এক বাঁধা পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে। বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চাইছে;‘আমরাও পারি।’

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘ইনজুরি টাইম’ ‘এক্সট্রা টাইম’ ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। তিনি কাজ করেছেন দেশের নেতৃস্থানীয় বিভিন্ন দৈনিকে, টেলিভিশন এবং দেশি-বিদেশি রেডিওতে।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।