হাজারীবাগে ট্যানারি সচল, দূষিত হচ্ছে ধলেশ্বরীও

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৩৮ এএম, ২১ আগস্ট ২০১৭

বিভিন্ন উপায়ে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে রাজধানীর হাজারীবাগে ট্যানারি কার্যক্রম সচল রেখেছেন ট্যানারি মালিকরা। পাশাপাশি সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্প নগরীতে কিছু কারখানার কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে ধলেশ্বরী নদীর পানি দূষিত করা হচ্ছে। আসন্ন কোরবানির ঈদে এ দূষণের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।

রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ‘আসন্ন ঈদে সাভারের অসম্পূর্ণ ট্যানারি-পার্ক : বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী অব্যাহত দূষণ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বুড়িগঙ্গা রিভারকিপারের পক্ষ থেকে এসব কথা বলা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- কলামিস্ট ও বাপার সহ-সভাপতি সৈয়দ আবুল মকসুদ, বুড়িগঙ্গা রিভারকিপার ও বাপার যুগ্ম-সম্পাদক শরীফ জমিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম, বাপার বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের সমন্বয়কারী মিহির বিশ্বাস প্রমুখ।

ট্যানারি শিল্পকে মারণাস্ত্র উল্লেখ করে বাপার পক্ষ থেকে বলা হয়, অতিরিক্ত মুনাফার আশায় ট্যানারি মালিকরা প্রতিদিন দেশের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করে মানুষের মুখে বিষ ঢেলে দিচ্ছে, মানুষকে মেরে দিচ্ছেন। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ায় অনেক বায়ার (ক্রেতা) মুখ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। যেটা ট্যানারি শিল্পের জন্য ক্ষতিকর।

বাপার পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য রাখেন শরীফ জামিল। তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশে গত ৮ জুলাই থেকে হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ শুরু হয়। তবে হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানাগুলোতে কার্যক্রম চালু রয়েছে। বিভিন্ন অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে কারখানায় বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়েছেন কারখানা মালিকরা। এমনকি বাসা-বাড়ি থেকেও অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে ট্যানারির কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

তিনি জানান, পরিবেশবান্ধব ট্যানারি শিল্পনগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঢাকার অদূরে ধলেশ্বরী নদীর তীর ঘেঁষে প্রায় ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। অধিগ্রহণ করা এলাকায় ১৫৫টি ট্যানারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্লট বিতরণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে প্লট বরাদ্দ পাওয়া ট্যানারি কোম্পানির সিংহভাগই তাদের স্থানান্তর প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।

‘বর্তমানে শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) দুটি মডিউল চালু আছে এবং আরও দুটিতে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ চলছে; যা শিগগির চালু হবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু সম্পূর্ণ প্লান্টের বর্জ্য ধারণ ক্ষমতা ২৫ হাজার কিউবিক মিটার। আর কোরবানির ঈদের পর পর একসঙ্গে বর্জ্যের পরিমাণ হবে তার কয়েকগুণ বেশি। ফলে সেই বর্জ্য সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে ছেড়ে দেয়া হবে,’ বলেন শরীফ জামিল।

তিনি বলেন, বর্তমানে প্রায় ৭০টি ট্যানারি ১২ থেকে ১৫ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য উৎপাদন করছে; যা চলমান দু’টি মডিউল হয়ে ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে পড়ছে। নদীতে পরিশোধিত বর্জ্যের নামে যা ফেলা হচ্ছে তা কালো এবং দুর্গন্ধময়। কঠিন বর্জ্য, লবণ ও ক্রোমিয়ামের পরিশোধন ও ব্যবস্থাপনার কোনো পদ্ধতি আদৌ এই প্লান্টের না থাকায় ধলেশ্বরী দূষণ একটি অবধারিত বিষয়।

শরীফ জামিল আরও বলেন, জানা গেছে, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য চীনা প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য একটি প্রস্তাব সরকারকে দিয়েছে। আর লবণ দূষণের ব্যবস্থাপনার জন্য আরও ৫০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। ফলে কবে ট্যানারিগুলো দূষণমুক্তভাবে পরিচালিত হবে, তা নিতান্ত অনিশ্চিত এবং সাভারের স্থানান্তরের মাধ্যমে ট্যানারির দূষণ বুড়িগঙ্গা ছাড়িয়ে ধলেশ্বরী ও কালিগঙ্গায় বিস্তৃতি লাভ করবে।

সাভারের সিইপিটি সঠিকভাবে হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাভারের সিইপিটি একটি বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট প্লান্ট হওয়ায় এর কার্যকারিতা বর্জ্যের পরিমাণ, মডিউল ধরে রাখার নির্দিষ্ট সময় ও মিশ্রিতব্য কস্টিকসোডা ও অন্যান্য উপাদানের পরিমাণের ওপর করে, যা যথাযথভাবে হচ্ছে বলে প্রতীয়মান নয়। সেই সঙ্গে বেশ কয়েকটি প্রয়োজনীয় পরিশোধন ব্যবস্থা সম্পূর্ণই অবর্তমান।

ট্যানারি স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকার যেমন কেন্দ্রীয় পরিশোধনাগার, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, রাস্তাঘাট, ব্যাংক ইত্যাদি নিশ্চিত করতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেছে, ঠিক তেমনিভাবে ট্যানারি মালিকরাও ২০১৫ সাল পর্যন্ত তাদের অবকাঠামোর নকশাই সরকারের কাছে জমা দেয়নি। অপরদিকে এই স্থাপন্তর প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই পর্যায়েই যেমন অসম্পূর্ণ পরিশোধন ব্যবস্থা সুপারিশ করা হয়, তেমনি বাস্তবায়ন পর্যায়েও সরকার ও ঠিকদার প্রতিষ্ঠানের ছিল সীমাহীন উদাসীনতা ও বিলম্ব।

সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়- ট্যানারি শ্রমিকরা বলছেন সাভারে কাজ করার পরিবেশ নেই এবং মালিকরা বলছেন ট্যানারি শিল্পকে ধ্বংস করার চক্রান্ত চলছে। এর উত্তরে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সাভারে শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থা, তাদের ছেলে-মেয়েদের স্কুলের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দাবি আমরা বারবার জানিয়ে আসছি। আর চক্রান্তের যে বিষয় বলা হচ্ছে এটা আমাদের জাতীয় সমস্য। যে কোনো বিষয়েই আমরা বলে দিই চক্রান্ত হচ্ছে।

একই প্রশ্নের উত্তরে শরীফ জামিল বলেন, ট্যানারি শিল্প কোনো শিল্প নয়। ট্যানারি শিল্প হচ্ছে একটি মারণাস্ত্র। প্রতিদিন তারা দেশের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করে মানুষের মুখে বিষ ঢেলে দিচ্ছে নিজেদের অতিরিক্ত মুনাফার জন্য। তারা তাদের যে কারখানা, সেই কারখানায় উৎসে বর্জ্য পরিশোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত করে যে খরচ হবে, সেই খরচকে ধরে তাদের মুনাফার হিসাব করে ব্যাংকে প্রস্তাব জমা দেন। কাজেই তারা যখন কারখানাটি স্থাপন করেন, তখনই তাদের উৎসে বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত ছিল। তারা দুই টাকা লাভের জায়গায় ১২ টাকা লাভের জন্য মানুষকে মেরে দিচ্ছেন দিনের পর দিন।

‘কাজেই এটা ষড়যন্ত্রের কোনো বিষয় না। এটা একটা সত্য ঘটনা। এ সত্য ঘটনা যখন জানাজানি হবে, তখন তো এর একটা প্রভাব থাকবেই। দেশে জানাজানি হচ্ছে, বিদেশে জানাজানি হচ্ছে, বায়াররা (ক্রেতা) জানছে, ফলে তারা বাংলাদেশের এক্সপোর্ট (রফতানি) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অনেকে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। যেটা ট্যানারি শিল্পের জন্য ক্ষতিকর। আমরা এটা চাই না। ষড়যন্ত্র যদি কেউ করে থাকে, তাহলে ট্যানারি মালিকরা নিজেরা নিজেদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।

সংবাদ সম্মেলনে বাপার পক্ষ থেকে চারটি দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো- এক. অবিলম্বে ট্যানারি বর্জ্য বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদী দূষণ বন্ধ করতে হবে। দুই. ট্যানারি স্থানান্তরে বিলম্ব ও অসম্পূর্ণ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার কারণ চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। তিন. দেশের সকল নদী ও জলাশয় দূষণ বন্ধে যে কোনো শিল্প কারখানার উৎসে বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। চার. আগামী ঈদের পরপর নদী, চামড়া ও চামড়া শিল্প রক্ষার উদ্যোগে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 

এমএএস/এনএফ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।