যানজটে বিলম্ব : কপাল পুড়েছে ফাতেমা সখিনাদের


প্রকাশিত: ০৪:৩৩ এএম, ০৩ জুন ২০১৫

যানজটে কপাল পুড়েছে দরিদ্র গৃহবধূ ফাতেমার। এক রাতের ভিখারি হয়ে দান খয়রাত হিসেবে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা উপার্জনের টার্গেট নিয়ে মঙ্গলবার শেরপুর নালিতাবাড়ির শিবপাড়া গ্রাম থেকে আজিমপুর কবরস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। নগদ দেড়শ টাকায় বাসের টিকেট কেটে সকাল ১১টায় রওয়ানা হলেও সড়কে তীব্র যানজটের কারণে আজিমপুর কবরস্থানের সামনে আসতে বেজে যায় রাত ৮টা। শবে বরাতের রাতে বাইরের চেয়ে কবরস্থানের ভেতরে আয় রোজগার অনেক বেশি তা গত বছরেই জেনে গিয়েছিলেন ফাতেমা।

কিন্তু যানজটের কারণে বিলম্ব হওয়ায় আগে থেকেই অন্যান্য ভিখারিরা কবরস্থানের ভেতরে জায়গা দখল করে নেয়ায় ফাতেমার জায়গা হয়নি ভেতরে। পরে বাইরের ভাল কোন জায়গায় বসার সুযোগ খুঁজলেও তা মেলেনি। পরে কবরস্থানের উচু দেওয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা চালালেও বেরসিক পুলিশ দু ঘা দিয়ে নামিয়ে দেয়। শেষে ঠাঁই হয় বিজিবি তিন নম্বর গেটের পাশের রাস্তায়।

এ প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে ফাতেমা তার পাশে বসে থাকা আরেক ভিখারিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, রাস্তার যানজটে আইজ কপাল পুড়ছে। আসা যাওয়ার ভাড়ার খরচ উঠবো কিনা সন্দেহ হইতাছে।

ফাতেমার মতো একই দশা কুমিল্লার বড়ুরার নুরজাহান, ময়মনসিংহ ভালুকার হাসনা বানু, বরিশালের জুলেখাসহ অসংখ্য ভিখারির।


কবরস্থান শব্দটি শুনলে কমবেশি সকলের বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠে। পারতপক্ষে কেউ কবরস্থানমুখী হননা। আর রাতের বেলায় দাফন-কাফন ছাড়া কবরস্থানে কেউ ঢুকবে এমন কল্পনাও করা যায়না।

কিন্তু শবে বরাতের রাতে আজিমপুর কবরস্থান ও এর আশেপাশের চিত্র একেবারেই ভিন্ন থাকে। সারারাত ধরে কবরস্থানের ভেতরে ও বাইরে থাকে লোকে লোকারণ্য।

প্রতিবারের মতো এবারও অসংখ্য মুসল্লী পাঞ্জাবি পায়জামা পরিধান করে কবরস্থানে এসেছিলেন চিরনিদ্রায় শায়িত স্বজনদের কবর জিয়ারত করতে। জিয়ারত শেষে কমবেশি সকলেই সওয়াব হাছিলের জন্য সাধ্যমত দান খয়রাত করছিলেন।

আর এ দান খয়রাত পাওয়ার আশায় কবরস্থানের ভেতরে বাইরে নানা বয়সী ভিখারিরা ভিড় জমিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে কবরস্থানের ভেতরের রাস্তার দুধারে ভিখারিদের কারণে চলাচলে সমস্যা হলে পুলিশ নতুন করে ভিখারিদের প্রবেশ বাধা দেয়। কিন্তু ভিখারিরা পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে উচু দেওয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টার দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো।


এ প্রতিবেদক উপস্থিত বেশ কিছু সংখ্যক ভিক্ষুকের সঙ্গে আলাপকালে জানতে পারেন এদের সিংহভাগের প্রকৃত পেশা ভিক্ষা নয়। তারা এক দুইদিনের মৌসুমী ভিখারি।

ঢাকায় নিয়মিত থাকেন ও ভিক্ষা করেন এমন ভিখারিরা তাদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। কেউ গ্রাম থেকে দুদিন আগেই আবার কেউবা শবে বরাতের দিন উপস্থিত হন।

পটুয়াখালীর গলাচিপার হানিফ মিয়া (৬৫)। ভিক্ষা করেই সংসার চালান। থাকেন জিগাতলায়। তিনি জানান, আল্লাহর রহমতে আয় রোজগার ভাল। প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা ভিক্ষা পাই। এবার গ্রাম থেকে ৫/৬ জনকে ভাড়া দিয়ে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন তিনি। শবে বরাতের রাতে যা পাওয়া যাবে তা থেকে ভাড়া ও খাওয়ার টাকা ও কিছু লাভ রেখে বাকি টাকা দিয়ে ওদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিবেন। আরও কিছু  লাভ হলে গরিব আত্মীয়রা একদিনে ভাল অঙ্কের টাকা রোজগার করে বাড়ি যেতে পারবেন।

ময়মনসিংহ গফরগাঁওয়ের হোসেনপুর গ্রামের রেজিয়া বেগম। সখিনা বেগম একজনের সঙ্গে রেজিয়াসহ মোট সাতজন এসেছেন। রেজিয়া জানান, সখিনা তাকে ঢাকায় আসার প্রস্তাব দিয়ে বলেছে শবে বরাতের রাতে মেলা ট্যাকা দান খয়রাত পাওয়া যায়। তবে টাকার ভাগাভাগি কিভাবে হবে তা মিটমাট করে আনেননি বলে জানান তিনি।

মঙ্গলবার বিকেল থেকে বুধবার ফজরের নামাজের পূর্ব পর্যন্ত কবরস্থানের ভেতরে বাইরে অসংখ্য মানুষের ভীড় থাকলেও ভোরের আলো উঁকি দেয়ার আগেই ম্যাজিকের মত মানুষগুলো অদৃশ্য হয়ে যার যার গন্তব্যে চলে যায়। ভিখারিদের কেউ কেউ কবরস্থানের গেটের আশেপাশে বসে টাকার হিসাব মেলাতে থাকেন। এভাবেই সাঙ্গ হয় অভাব আর স্বভাবের দোলাচলে একদিনের ভিখারিদের মিলনমেলা।

এমইউ/এএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।