প্রধান বিচারপতির রায় আবেগ ও বিদ্বেষতাড়িত

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:৫১ এএম, ১০ আগস্ট ২০১৭

বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছ থেকে জাতীয় সংসদের হাতে দেয়া ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে বলেও জানান আনিসুল হক।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের নয়দিন পর এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানালেন আইনমন্ত্রী।

মন্ত্রী বলেন, ‘আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন সেই রায়ের সঙ্গে আমাদের দ্বিমত থাকলেও রায়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রয়েছে। আমি অত্যন্ত বিনীতভাবে বলতে চাই যে, শ্রদ্ধেয় আপিল বিভাগ যে যুক্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করেছেন সেই যুক্তি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।’

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি মামলার ফ্যাক্ট ইন ইস্যু’র (মূল বিষয়) বাইরে গিয়ে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধান পরিপন্থী বলে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তাতে আমরা বিস্মিত হয়েছি । আমরা ধন্যবাদ জানাই সেই চারজন বিচারপতিকে যারা তার ওই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘শুধু এটুকু বলতে চাই যে, এই ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধান পরিপন্থী আখ্যায়িত করায় আমার মনে হয় প্রধান বিচারপতির যে রায় দিয়েছেন তা যুক্তিতাড়িত নয় বরং আবেগ ও বিদ্বেষতাড়িত।’

‘ষোড়শ সংশোধনী দ্বারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরও সুদৃঢ় ও স্বচ্ছ হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল’ জানিয়ে আনিসুল হক বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করা এবং গণতন্ত্রের মৌলিক মন্ত্র চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স পদ্ধতিতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার উদ্দেশ্যে ষোড়শ সংশোধনী পাস করি।’

রায়ের রিভিউ করার চিন্তা

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যেহেতু এই রায়ে সংক্ষুব্ধ তাই আমরা নিশ্চয়ই চিন্তা-ভাবনা করছি যে, এই রায়ের রিভিউ করা হবে কি না। আমরা এখনও কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হইনি। কারণ রায়ের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো এখনও নিবিড়ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পুর্ণাঙ্গ কপি আমরা পেয়েছি। যেহেতু রায়টি ৭৯৯ পৃষ্ঠার তাই এটি সম্পূর্ণ পড়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে আমার এটুকু সময় লেগেছে।’

রায়ের আপত্তিকর বক্তব্য এক্সপাঞ্জের উদ্যোগ

আনিসুল হক বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি তার রায়ে অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন, যেটা এই মামলার ফ্যাক্ট ইন ইস্যু’র (মূল বিষয়) সঙ্গে একদমই সম্পর্কিত নয়, এমন বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন এবং এই প্রতিষ্ঠানকে হেয়প্রতিপন্ন করেছেন। আমি মনে করি, ওই সব রাজনৈতিক প্রশ্ন আদালত কর্তৃক বিচার্য বিষয় হতে পারে না। আমরা তার এই বক্তব্যে দুঃখিত।’

মন্ত্রী বলেন, ‘তিনি রায়ের আরেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো একক ব্যক্তির কারণে হয়নি। আমি তার এই বক্তব্যে মর্মাহত। আমরা স্মরণ করতে চাই যে, ইতিহাস বলে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যে আন্দোলনগুলো হয়েছে তারই ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু হয়তো পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন কিন্তু তারই নেতৃত্বে, তারই আদর্শে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল।’

‘এটা ভুললে চলবে না যে, জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ছাড়া এ দেশের আর কেউ ১৩ বছরের বেশি কারাভোগ করেননি। তাই মাননীয় প্রধান বিচারপতি এই বক্তব্য আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। ইতিহাস এ কথাও বলে যে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীকার আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জনগণের দেয়া ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।’

আনিসুল হক বলেন, ‘আজ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এই বাস্তব সত্যকে পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে সেটাই আমার জন্য অনেক কষ্টের এবং লজ্জার। তাই আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে, আমাদের নিরীক্ষায় প্রধান বিচারপতির রায়ে যে সব আপত্তিকর এবং অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য আছে সেগুলো এক্সপাঞ্জ করারও উদ্যোগ আমরা নিব।’

‘দেশকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অপরাধীদের নৈরাজ্য, অপসংস্কৃতি এবং গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করার প্রথা থেকে শেখ হাসিনার সরকারই মুক্ত করেছেন। তাই রায়ে যখন উল্লেখ থাকে যে, আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করছি ষোড়শ সংশোধনী দ্বারা, তখন ব্যথিত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না।’

বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছ থেকে জাতীয় সংসদের হাতে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয় ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। যে বিধানটি ১৯৭২ সালের সংবিধানেও ছিল।

সংবিধানের এই সংশোধন মৌল কাঠামোতে পরিবর্তন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করবে- এমন যুক্তিতে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়।

ওই রিটের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল জারি করেন। ২০১৬ সালের ১০ মার্চ মামলাটির চূড়ান্ত শুনানি শেষে ৫ মে রায় দেন আদালত। রায়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়। চলতি বছরের ৩ জুলাই ওই রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ১ আগস্ট।

আরএমএম/এমএআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।