ইয়াবা : আভিজাত্যের খোলসে মরণ ছোবল
২৪ বছর বয়সী রাফির চোখটা গাঢ় লাল হয়ে উঠেছে, মুখ ফ্যাকাশে। ইয়াবা নিয়ে মায়ের কাছে ধরা পড়ার পর সে বুঝে উঠতে পারছিল না এখন কী করা উচিত তার।
রাফি চাচ্ছিল না তার মা কিছু জানুক, কিন্তু তাকে থামানোর চেষ্টাও করেনি সে। ২০০৬ সাল থেকেই ইয়াবায় আসক্ত রাফি। মূলত ওই সময় থেকেই রাজধানী ঢাকার বহু ধনাঢ্য পরিবারের ছেলেমেয়েরা ইয়াবা সেবন শুরু করে। তাদেরই একজন রাফি।
রঙিন এই বড়ির প্রতি বাংলাদেশে তরুণদের আসক্তি শুরু ওই সময় থেকেই। তখন এর বিস্তার ধনীদের মধ্যে থাকলেও এখন তা অনেক সহজলভ্য। পাওয়া যাচ্ছে সবখানে।
ইয়াবা মূলত মেথামফেটামিন এবং ক্যাফেইনের সংমিশ্রণ। উজ্জ্বল রঙে ছোট ছোট বড়িগুলো নানা ফ্লেভারে পাওয়া যায়। ধাতব ফয়েলে পুড়িয়ে ধোঁয়া হিসেবে এটি সেবন করা হয়। আবার কখনও এই বড়ি গুঁড়ো করেও সেবন করে অনেকে।
বাংলাদেশে ইয়াবার বিস্তারে রোববার দীর্ঘ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সিএনএন। এতে বলা হয়েছে, গত বছর প্রায় তিন কোটি পিস ইয়াবা জব্দ করেছে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
জাতিসংঘের মাদক এবং অপরাধ বিষয়ক সংস্থার (ইউএনওডিসি) ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, মেকোং নদ দিয়ে এর আশপাশের এলাকা এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জব্দকৃত অধিকাংশ ইয়াবাই মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে।
মেথামফেটামিন ট্যাবলেট উৎপাদনের প্রধান দেশ হিসেবে মনে করা হচ্ছে মিয়ানমারকে। ২০০০ সাল থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসতে শুরু করে। এখন এসব অঞ্চল ছাড়াও বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে ইয়াবা।
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে চীনে জব্দ হওয়া ‘তাবা’ (ইয়াবা) পিলের ৯০ শতাংশই মেথ হিসেবে মিয়ানমারে তৈরি। ২০১০ সালের তুলনায় গত বছর জব্দ করা ইয়াবা ৩৫ গুণেরও বেশি।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দিদারুল আল রাশেদ কক্সবাজারে মিয়ানমার সীমান্তের কাছে একটি মাদক চিকিৎসাকেন্দ্র চালাচ্ছেন। সেখানে প্রায় ২৪ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার ওই সংস্থাটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যা ন্যাশনাল গোলস টু বি অবটেইনড অ্যান্ড রিটেইনড-এর (এনওএনজিওআর) অংশ হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশে ইয়াবা ছড়িয়ে পড়া এবং ব্যাপকভাবে ইয়াবা আসক্তির বিষয়টির তিনি চাক্ষুষ প্রমাণ। তিনি বলেন, ‘আমরা ২০০২ সালে অনানুষ্ঠানিক একটি জরিপ চালিয়েছিলাম। সে সময়ই ওই জরিপের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, কক্সবাজার জেলার প্রায় ২০ হাজার মানুষ মাদকাসক্ত। সে সময় তারা কেউই ইয়াবা সেবন করত না। তাদের নেশার প্রধান উপকরণ ছিল গাঁজা এবং হেরোইন।
কিন্তু ২০০৭ সালে যেন দেশে ইয়াবার বন্যা বয়ে গেল। সবখানে সহজেই ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছিল। ২০১৬ সালে আমরা যখন আবারও একটি জরিপ চালালাম তখন দেখা গেল ওই অঞ্চলের প্রায় ৮০ হাজার মানুষ মাদকাসক্ত এবং এদের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগই ইয়াবা সেবন করে।
ইয়াবা বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ২০১৩ সালে নিজের বাবা-মাকে হত্যা করে আলোচনায় আসে কিশোরী ঐশী রহমান (১৭)। সিএনএন বলছে, এই ঐশীও আসক্ত ছিল ইয়াবায়। ২০১৫ সালের নভেম্বরে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। ঐশীর এই বিষয়টিও উঠে এসেছে সিএনএনের দীর্ঘ প্রতিবেদনটিতে।
চলতি বছর ঐশীর বয়স এবং তার মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে নিম্ন আদালতের ওই রায় পরিবর্তন করে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট।
ঐশীর ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পরে বাংলাদেশে ইয়াবা আসক্তি এবং তরুণ সমাজে এর কুপ্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন অভিভাবকরা। মাদকাসক্তি তরুণ সমাজের মানসিকতা নষ্ট করে দিচ্ছে; যার ফলে তারা নানা ধরনের অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। ঐশীও ইয়াবা আসক্তির কারণেই বাবা-মাকে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করেছেন বলে মনে করেন অনেকেই।
ডিপার্টমেন্ট অব নারকোটিক কন্ট্রোলের (ডিএনসি) ২০১৪ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, শতকরা ৮৮ ভাগ মাদক সেবনকারীর বয়স ৪০-এর নিচে। অর্থাৎ তরুণ সমাজই মূলত মাদকাসক্ত। সিলেট শহরের চলতি বছরের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৫৫ ভাগ মাদক সেবনকারীর বয়স ২২ থেকে ২৯।
ইয়াবা-আসক্ত রাফি বলেন, এর ঘ্রাণ ভ্যানিলার মতো কিন্তু এটা থেকে নির্গত ধোঁয়ার স্বাদ আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না।
তিনি আরও বলেন, যখন নতুন মাদক হিসেবে ইয়াবা সম্পর্কে জানতে পারলাম তখন সবাই এটাই চাইত। এটা হেরোইনের চেয়ে ভালো ছিল। কারণ হেরোইন শরীর দুর্বল করে দেয় কিন্তু ইয়াবা খাওয়ার পর তেমনটা হয় না।
১৯৯০ সালের দিকে প্রতিবেশী মিয়ানমারের মাদক কারবারীরা হেরোইন বানানোর পরিবর্তে ইয়াবা বানানো শুরু করে। কারণ এটা আকারে ছোট, দেখতে আকর্ষণীয় এবং সহজে বহনযোগ্য।
উৎপাদনকারীরা ইয়াবার প্যাকেটের গায়ে বিভিন্ন প্রতীক ব্যবহার করে থাকেন। এগুলো ব্র্যান্ড হিসেবে কাজ করে। যেমন বাংলাদেশে আর-৭ সবচেয়ে জনপ্রিয়। আর-৭য়ের একটি ট্যাবলেটের দাম ৯শ টাকা। সবচেয়ে সস্তা ইয়াবা ‘পিংক চম্পা’র দাম মাত্র ৩শ টাকা। আর সবচেয়ে শক্তিশালী ব্র্যান্ড হচ্ছে ‘কন্ট্রোলার;’ যার দাম ২ হাজার টাকা।
চীন এবং থাইল্যান্ডের সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের কারণে মাদকচক্রগুলো বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ঢোকার জন্য অন্য ‘রুট’ খুঁজছিল। তারা নতুন রুট খুঁজেও নেয়।
ইয়াবা বাংলাদেশে আসার পর প্রথম দিকে তা মুষ্টিমেয় কিছু লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ডিএনসির এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্মার্টনেস, ফ্যাশন আর আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল ইয়াবা। নামীদামী মডেল, নায়ক-নায়িকা, সংগীত শিল্পী, নৃত্য শিল্পী এবং বহু সেলিব্রিটি ইয়াবা আসক্তির কারণে খবরের শিরোনাম হয়েছেন।
ইউএনওডিসির আঞ্চলিক প্রতিনিধি জেরেমি ডোগলাস বলেন, প্রকৃত সমস্যা এখনও আমাদের অজানা। সংগঠিত অপরাধ বিকাশে বাংলাদেশে ইয়াবার একটি আকর্ষণীয় বাজার তৈরি হয়েছে। আমরা বাংলাদেশে ইয়াবা/মেথের সঠিক পরিসংখ্যানের হিসাব দিতে পারছি না। তবে যে হারে ইয়াবা জব্দ হচ্ছে তা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, মাদক পাচারকারীরা এখানে প্রচুর ইয়াবা পাঠাতে সক্ষম হচ্ছেন। তবে সেটার সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত ৪ হাজার কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের সঙ্গে ২৫০ কিলোমিটার। কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী সিএনএনকে বলেছেন, আমাদের সরকার ইয়াবা বন্ধের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু এটা সম্ভব হচ্ছে না কারণ কিছু কনিষ্ঠ কর্মকর্তাই মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত এবং কিছু নির্বোধ সীমান্তরক্ষী টাকার বিনিময়ে পাচারকারীদের কাছ থেকে মাদক নিয়ে তা দেশে প্রবেশ করাচ্ছে। কারা এর সঙ্গে জড়িত তা বের করা খুবই কঠিন।
কক্সবাজারের নারকোটিস কন্ট্রোল অফিসের সহকারী পরিচালক সোমন মন্ডল দেশে ইয়াবা প্রবেশে সীমান্তরক্ষীদের হাত আছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার কর্মীদের মাদক পাচারের বিষয়ে আমার কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি।
সিএনএনে প্রকাশিত ‘ইয়াবা অ্যাডিকশন : দ্য ডার্ক সাইড অব বাংলাদেশ’স ইনক্রিজিং অ্যাফলুয়েন্স’ থেকে সংক্ষেপিত।
টিটিএন/এনএফ/এমএস