সাগরপথে ইউরোপে প্রবেশকারীদের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম
এ বছর সাগরপথে অবৈধভাবে যত লোক ইউরোপে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের কাজ করা সংগঠন ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত শুধু ভূমধ্যসাগর পথ পাড়ি দিয়েই সাত হাজার ৮৯৯ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছে।
শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে অনুষ্ঠিত এক পরামর্শ সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ৩০ জুলাই আন্তর্জাতিক মানবপাচার বিরোধী দিবস উপলক্ষে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক এ সভার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, জুলাই মাসের শুরুতে তুরস্ক জানিয়েছে, অবৈধ পথে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টায় তুরস্কে গিয়ে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশি আটকা পড়েছেন। ইউরোপের এই চিত্রের পাশাপাশি সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ড যাওয়া এবং সেখানকার গণকবরের কথা চিন্তা করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। মালয়েশিয়াও সম্প্রতি অবৈধ বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। অভিযানের প্রস্তুতি চলছে সৌদি আরবেও।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত আট বছরে প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি বৈধ কাগজপত্র না থাকায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, এ বছর মানবপাচার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থানের অবনমন ঘটেছে। এই প্রতিবেদনে দেশগুলোকে তিনটি স্তরে বা টায়ারে ভাগ করা হয়। গত পাঁচ বছর বাংলাদেশকে রাখা হয়েছিল দ্বিতীয় স্তরে (টায়ার-টু)। এবার এক ধাপ নামিয়ে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় স্তরের ‘নজরদারিতে থাকা দেশের তালিকায় (টায়ার-টু ওয়াচ লিস্ট)’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে সৌদি আরব, আলজেরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও হংকংসহ ৪৫টি দেশ। বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছে এবং নিরাপদ অভিবাসন প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে তখন এই চিত্র উদ্বেগজনক।
বক্তারা আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু সংস্থার তথ্য তুলে ধরে বলেন, গত চার বছরে প্রায় দেড় লাখ লোক বঙ্গোপসাগর দিয়ে মানবপাচারের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত দেড় হাজার মানুষ সাগরেই মারা গেছেন। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দুই শতাধিক মরদেহ, যার মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশি।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে মানবপাচার দমন ও প্রতিরোধ আইন হওয়ার পর গত পাঁচ বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মামলা হয়েছে। তবে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এসব মামলার অধিকাংশরই এখন পর্যন্ত বিচার হয়নি। ব্র্যাকের স্ট্র্যাটেজি, কমিউনিকেশনস অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট কর্মসূচির ঊর্ধ্বতন পরিচালক আসিফ সালেহ’র সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং রামরুর সমন্বয়ক সি আর আবরার, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ, সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মো. শাহ আলমসহ আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সিনিয়র সাংবাদিকবৃন্দ।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান। নানা বিশ্লেষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ইউরোপে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ঠিক কত সংখ্যক বাংলাদেশি আছেন তার কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে গত এপ্রিলে ঢাকা সফরকারী ইইউ প্রতিনিধি দল ইউরোপে ৮০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশির উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দফতর ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-২০১৫ সাল পর্যন্ত আট বছরে ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশি ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। চলতি বছরের ছয় মাস ধরলে এই সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
এমএ/ওআর/আরআইপি