মানবপাচারে জড়িত থাইল্যান্ডের পুরো একটি গ্রাম


প্রকাশিত: ০১:০৩ পিএম, ২২ মে ২০১৫

বিবিসির সাংবাদিক জনাথন হেডের অনুসন্ধানে থাইল্যান্ডে মানবপাচারের ভয়কর রূপ বেরিয়ে এসেছে। অনুসন্ধানে নেমে এই সাংবাদিক দেখেছেন, কীভাবে একটি পুরো গ্রাম শুধুমাত্র টাকার জন্য পাচারকারীদের সাহায্য করছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে কিছু থাই স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে থাই জঙ্গল চষে বেরিয়েছেন এ সাংবাদিক। দেখেছেন, জঙ্গলে অভিবাসীদের ওপর চালানো নৃশংস নির্যাতনের চিহ্ন। শুনেছেন, কীভাবে গ্রামবাসী মানবপাচারে এসব পাচারকারীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করে আসছে। থাই জঙ্গলে মানবপাচার এখন অনেক বড় এক ব্যাবসা।

এ ব্যবসাটা একটা ইকো সিস্টেমের মতো। প্রতিটি ধাপেই কেউ না কেউ আছেন যারা পরবর্তী ধাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। আশেপাশের গ্রামের গরীব মানুষদের নিত্যদিনের আয়ের তুলনায় মানবপাচারে অনেক বেশি আয়ের সুযোগ থাকায় সবাই ঝুঁকছেন এ পেশায়। এখানকার বিজনেজ মডেল হচ্ছে পাচারকারীরা তিনশো অভিবাসীবাহী একটি নৌকা প্রায় বিশ হাজার ডলারে কিনে নেয়। এরপর এ অভিবাসীদের নিয়ে আসেন ঘন জঙ্গলে। এখন থেকেই প্রত্যেক অভিবাসীর অভিভাকদের কাছে ফোন করে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। মাথাপ্রতি দুই থেকে তিন হাজার ডলার মুক্তপণ নেয়া হয়, যেটা এসব গ্রামবাসীদের জন্য যথেষ্ট।

কিন্তু পাচারকারীরা কীভাবে গ্রামবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন? জনাথন হেড বলেন, থাই জঙ্গল থেকে নিকটবর্তী শহর হাট ইয়াইয়ে যেতে আনুমানিক ৩০ মিনিটের মতো সময় লাগে। ক্যাম্পের পাশের গ্রামের এক থাই মুসলিম বালক বলছিলেন, কীভাবে তিনি এ পেশায় জড়িয়ে পড়লেন।

`কয়েকবছর আগে আমি পাখি শিকার করতে করতে এরকম একটি ক্যাম্পে চলে আসি। ক্যাম্পগুলোতে নারী, পুরুষ শিশুদের ওপর নির্যাতনের দৃশ্য দেখি আমি। তখন থেকেই আমরা পালিয়ে আসা অভিবাসীদেরকে আশ্রয় দিতে শুরু করি। পুরো গ্রামবাসী এটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এতে প্রচুর টাকা আছে। পাচারকারীরাই আমাদের কাজে লাগায়। ক্যাম্প পাহারা দেয়া, রোহিঙ্গাদের জন্য খাবার নিয়ে আসা ইত্যাদি কাজ করতে হয় আমাদের। পাচারকারীরা প্রত্যেক ঘরে ঘরে গিয়ে এসব কাজ করার জন্য মানুষের খোঁজ করে। আমাদেরও সুবিধা। রাবার বিক্রির টাকার সঙ্গে এটা একটা বাড়তি আয় হয়।

এ যুবক বলছিলেন, গ্রামের যুবকদেরকে এরা বিভিন্নসময় মাদক দিয়ে থাকেন, যাতে তারা পাচারকারীদের পক্ষে কাজ করে। এতে করে কোনো অভিবাসী যদি ক্যাম্প থেকে পালিয়েও আসে, তাহলে সে গ্রামবাসীদের হাতে ধরা খায়, এবং কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হয়। এদিকে এ ভয়াবহ ও নৃশংস মানবপাচারের সঙ্গে থাই কর্তৃপক্ষেরও জড়িত থাকার অভিযোগ অাসছে।

বলা হচ্ছে, কর্তৃপক্ষের সায় ছাড়া এতো বিশাল পরিসরে মানবপাচার সম্ভব নয়। তবে কর্তৃপক্ষ ঠিক কতোটা ইনভলভমেন্ট এখানে আছে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপ গমনকারী হাজার হাজার অভিবাসীরা পুরো বিশ্বকে এক মানবিক প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে’ বলেছেন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রধান এলহাজ অ্যাস সাই। ‘শুধুমাত্র আমাদের মানবতার পরীক্ষা হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি উত্তীর্ণ হতে পারবো?’ সম্প্রতি এশিয়াতে অভিবাসন বিষয়ক এক সম্মেলন শেষে জেনেভায় এসে এএফপিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে বিশ্বনেতাদের কাছেই হয়তো প্রশ্ন রাখেন তিনি।



এ দিকে, সাগরে ভাসমান বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসীদের জন্য নিজেদের জলসীমা নিষিদ্ধ করলেও পরে মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। শুধু তা-ই নয় এবার সেখানকার রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতি তাদের চাকরি দেয়ারও প্রস্তাব দিয়েছে। বৃহস্পতিবার মালয়েশীয় দৈনিক দ্য স্টারে এমন খবর প্রকাশ করা হয়েছে। দ্য মালয়েশিয়ান ইন্ডিয়ান মুসলিম রেস্টুরেন্ট ওনার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে উলে­খ করা হয়েছে।

সমিতির সভাপতি নুরুল হাসান সাউল হামিদের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটি বলেছে, তাদের এ প্রস্তাব মালয়েশিয়া সরকারের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। যেখানে সরকার সাগরে ভাসমান অবৈধ অভিবাসীদের অস্থায়ী আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছে। নুরুল হাসান বলেন, ‘আমরা তাদের জন্য সহায়তার হাত আরেকটু প্রসারিত করতে চাই। এরা আমাদেরই ভাই-বোন।’ সমিতির অনেক সদস্য এ বিপদগ্রস্ত মানুষদের নিজ পায়ে দাঁড়ানোর মতো ব্যবস্থা করে দিতেও ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

নুরুল হাসান বলেন, ‘আমরা সরকার বা আমাদের সদস্যদের এ ব্যাপারে কোনোভাবেই চাপ দিচ্ছি না। আমরা একেবারেই মানবিক কারণে এ প্রস্তাব দিয়েছি। আর আমাদের সদস্যরাও স্বেচ্ছায় এ ব্যাপারে রাজি হয়েছেন। আমাদের বুঝতে হবে- যদি তাদের আমাদের উপকূলে অবতরণ করার অনুমতি দেয়া হয় তাহলে তাদের ও পরিবারের রুজির বিষয়টা থেকেই যাচ্ছে। যদি তারা কাজ পায় তাহলে তাদের নানা সামাজিক সমস্যা এবং অপরাধের সঙ্গে তাদের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেকখানি কমবে।’

এদিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সংলগ্ন মিয়ানমার জলসীমায় অবৈধ অভিবাসী নিয়ে কয়েকটি নৌযান এখনো অপেক্ষমান রয়েছে। এ অভিবাসীদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এদিকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় পাওয়া বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আইওএম যে উদ্যোগ নিয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন ওই সংস্থার বাংলাদেশ মুখপাত্র আসিফ মুনীর।

এদিকে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী ড. ওয়ান জুনাইদি তুয়াঙ্কু জাফর বলেন, শরণার্থীবিষয়ক কাগজপত্র চূড়ান্ত করার পরই তাদেরকে ফেরত পাঠানো হবে। মালয়েশিয়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় আসা অবৈধ বাংলাদেশিদের সঙ্গে আরো রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। তাদেরকে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ইউএনএইচসিআরের হাতে তুলে দেওয়া হবে। আর অবৈধ বাংলাদেশিদের কাগজপত্র সম্পন্ন হওয়া মাত্রই তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে।

ড. ওয়ান জুনাইদি তুয়াঙ্কু জাফর রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুকে মিয়ানমারের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে বর্ণনা করেন। এ বিষয়টির সমাধান করতে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। উপমন্ত্রী বলেন, অবৈধ প্রবেশের দায় নিতে পারে না মালয়েশিয়া। ওই দেশে চাকরির জন্য লাখ লাখ অবৈধ শ্রমিকের সমস্যা মোকাবিলা করছি। এতে স্থানীয় সামাজিক জীবনে ব্যাপক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। চাকরি ক্ষেত্রে স্থানীয়রাও সমস্যায় ভুগছেন। অনেক ক্ষেত্রে এসব অবৈধ মানুষ বহন করে আনছে নানা রোগ ব্যাধি। এই রোগ বালাই ছড়াচ্ছে আমাদের দেশে। তিনি বলেন, অবৈধ প্রবেশকারীদের স্বাগত জানাবে না মালয়েশিয়া। আর রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সেটাতো মিয়ানমারের সমস্যা।

এ বিষয়ে মালয়েশিয়া লেবার কনস্যুলার সাইদুল ইসলাম মুকুল বলেন, লাঙ্কাবিতে আটক বাংলাদেশি শ্রমিকদের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য আমি ছুটে গেছি। সেখানে আমাদের বাংলাদেশি শ্রমিকদের কোনো প্রকার যেন নির্যাতন না করা হয় বাংলাদেশ হাইকমিশন তরফ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। তারাও আমাদেরকে আশ্বাস দিয়েছেন। কোনো প্রকার হয়রানি করা হবে না। বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা জেনেছি আমাদের শ্রমিকদের খুব শিগগিরই দেশে পাঠানো হবে।

বিএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।