সুন্দরবনের ভাগ্য জানা যাবে শুক্রবার


প্রকাশিত: ০২:৩০ পিএম, ০৫ জুলাই ২০১৭

বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ অঞ্চল সুন্দরবন ‘ন্যাচারাল ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ বা প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা থেকে বাদ পড়বে না থাকবে, তা জানা যাবে শুক্রবার। বিষয়টি আগামী ৭ জুলাই কাউন্সিলের বৈঠকে উত্থাপন হবে। সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে বিপন্ন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে কিনা সে বিষয়ে শুনানি হবে। এতে উপস্থিত থাকবেন আবেদন করা ৪০টি পরিবেশবাদী সংগঠন ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা।

তবে সুন্দরবনকে এই মর্যাদা থেকে বাদ দিতে সরব বিশ্বের ৪০টি পরিবেশবাদী সংগঠন। কারণ এ বনের অদূর রামপালে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে বাংলাদেশ সরকার ও ভারত। এতে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হবে বলেই ধারণা তাদের। তবে সুন্দরবনের এ মর্যাদা রক্ষায় সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের কাউন্সিলের সভায় তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার থেকে ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডে শুরু হওয়া এ সভা চলবে আগামী ১২ জুলাই পর্যন্ত। সেখানেই সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য থেকে বাদ দেয়ার চেষ্টা চলছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল এখন পোল্যাল্ডে রয়েছে। সুন্দরবনকে যেন কোনোক্রমেই বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা থেকে বাদ দেয়া না হয়, তা ঠেকানোই প্রতিনিধি দলের লক্ষ্য। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, সুন্দরবনকে বিশ্বের ঐতিহ্যের মর্যাদা থেকে বাদ দেয়ার জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বের ৪০টি পরিবেশবাদী সংগঠন খোলা চিঠি দেয় ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারের কাছে। সে চিঠি আমলেও নিয়েছে সংস্থাটি, যা পোল্যান্ডে চলা কাউন্সিলের আলোচনা সূচিতে রয়েছে।

জানা গেছে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ ম্যানগ্রোভ বনকে রক্ষায় সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলোও তুলে ধরা হবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না, এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেয়া হবে।

কাউন্সিলে অংশ নিতে বাংলাদেশের ১৩ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। বাকিরা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি। তারা ইতোমধ্যে বৈঠকগুলোতে অংশ নিচ্ছেন। একই সঙ্গে চালাচ্ছেন কূটনৈতিক তৎপরতাও। তবে কাউন্সিলের ৪১তম বার্ষিক সভার প্রস্তুতি বৈঠক হয় ২ ও ৩ জুলাই। এতেও অংশ নেয় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। সুন্দরবনকে বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্তের জন্য তুলে ধরা যুক্তিগুলো সম্পর্কে তারা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে জবাব দেয়ার প্রস্ততি নিয়েছেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে, পরিবেশবাদীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এবং সুন্দরবন নিয়ে ইউনেস্কোর প্রতিনিধি দলের সফরের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যে কোনো সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিনিধি দলের এক সদস্য জানান, সুন্দরবনকে রক্ষার একগুচ্ছ প্রস্তাব আলোচনায় উপস্থাপন করা হবে। এগুলো বিবেচনায় নিলে সুন্দরবন তার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারবে বলে মনে করেন তিনি।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দাবি, রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ফলে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হবে। এ ছাড়া বনের ভেতর দিয়ে কয়লা, সার ও জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে, এগুলোর কারণেও বনের ক্ষতি হচ্ছে। এমনকি বনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা বিভিন্ন নদীতে প্রায়ই তেল, কয়লা ও সারবাহী ট্যাংকার ডুবে জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি করছে। এগুলো বন্ধের জন্য ইউনেস্কো ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বারবার প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা হলেও আমলে নেয়নি সরকার। এর মাঝে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের ওপর অত্যাচারটা আরও বেড়ে যাবে। ফলে বিপন্ন হতে পারে এর অস্তিত্ব। তাই সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে উল্টো বিপন্ন তালিকায় অন্তর্ভুক্তের সুপারিশ পরিবেশবাদীদের।

এর আগে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের ক্ষতি করবে, এমন তথ্য দিয়ে এর আগে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কাউন্সিলের ৩৯ ও ৪০তম বার্ষিক সভায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ প্রকল্প সুন্দরবনের জন্য ‘মারাত্মক হুমকি’ উল্লেখ করে তা বাতিল বা অন্যত্র সরিয়ে নিতে গেল বছরও সরকারের প্রতি লিখিত আহ্বান জানায় ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে জবাব দিলে ইউনেস্কোর একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে যায়। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পাঁচ মাস পর সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠায় সংস্থাটি।

এতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বা ইআইএ করেছে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) নামের একটি সংস্থার মাধ্যমে। কিন্তু ওই ইআইএ আন্তর্জাতিক মানের হয়নি, উঠে আসেনি সঠিক চিত্র। মূলত রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সেখানকার জীববৈচিত্র্যের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইউনেস্কোর নিজস্ব প্রতিবেদনে যেহেতু রামপাল বিষয়ে এমন মনোভাব ফুটে উঠেছে সে কারণে ওই বৈঠকে সুন্দরবনের বিষয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্তও আসতে পারে। তাই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কাউন্সিলের সভাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে সরকার। তাই সরকারের গৃহীত বিভিন্ন ধরনের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কর্মকর্তারা সেখানে অবস্থান করছেন। সুন্দরবন নিয়ে কোনো নেতিবাচক আলোচনা শুরু হলেই তারা এর বিপরীতে সরকারের নেয়া উদ্যোগগুলো তুলে ধরবেন।

১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো থেকে সুন্দরবনকে বিশ্বের ৫২২তম বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান দেয়। কিন্তু তার কয়েক বছর পর অর্থাৎ ২০১৪ সালের ১১ জুলাই সরকারকে চিঠি দিয়ে উল্টো সতর্ক করা হয়। ইউনেস্কোর চিঠিতে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় এ বনের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সরকার ব্যর্থ হলে বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান হারাবে সুন্দরবন। নাম লেখাবে বিপন্ন বিশ্বঐতিহ্যের তালিকায়। এ ছাড়া সুন্দরবন রক্ষায় কী উদ্যোগ নেয়া হবে তা উলে­খ করে ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন চাইলেও এর কোনো উত্তর পায়নি ইউনেস্কো।

তবে ইউনেস্কোর মতে, শুধু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রই সুন্দরবনের জন্য প্রধান সমস্যা নয়। এ বিদ্যুকেন্দ্রের ফলে সুন্দরবনের পাশে রামপালের উজানে আরও মারাত্মক দূষণকারী শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে।

এমএ/জেএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।