নতুন পে-স্কেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ১৪ লাখ চাকরিজীবী

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:৩৪ পিএম, ২০ মে ২০১৫

সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য নতুন পে-স্কেল চূড়ান্ত করা হয়েছে। নতুন এ স্কেল অনুযায়ী আগামী জুলাই মাস থেকেই তারা বেতন পাবেন বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক। নতুন বেতন কাঠামোর আওতায় সুবিধা পাবেন ২১ লাখ চার হাজার সরকারি চাকরিজীবী।

তবে পে কমিশনের সুপারিশের আলোকে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল সুবিধা বাতিল করা হলে ছয়টি মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ১৩ লাখ ৭৬ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। মন্ত্রণালয়গুলোর মোট জনবলের সংখ্যা ১৮ লাখ ২৪ হাজার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পর্যালোচনায় এ চিত্র উঠে এসেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড সুবিধাবঞ্চিত করা হলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। অন্যদিকে সব চাকরিজীবীর মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বেতন ও চাকরি কমিশন টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দিয়ে বলেছে, সুপারিশকৃত বেতনের মধ্যে টাকার অঙ্কে দূরত্ব বৃদ্ধি এবং পাঁচ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট চক্রবৃদ্ধি হারে প্রদান করতে বলা হয়েছে। এতে ১৫ বছরে বেতন দ্বিগুণ হবে। আর জনপ্রশাসনে যে সংস্কার, পদোন্নতির মাধ্যমেই ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি-বেতন বৃদ্ধি হবে।

বেতন কমিশনের এ সুপারিশের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, শিক্ষকসহ যেসব পদে কোনো পদোন্নতি নেই তাদের বেতন ১৫ বছর পর দ্বিগুণ হলে তারা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনযাপন করতে পারবেন না। আর ক্যাডার সার্ভিসের যে অবস্থা তাতে সবার পদোন্নতি নিশ্চিত করা কঠিন। সর্বোপরি টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড হঠাৎ করে বিলুপ্ত ঠিক হবে না। সব শ্রেণির সরকারি কর্মচারী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলনে যাচ্ছেন সরকারি কর্মচারীরা। এ নিয়ে হতাশ হয়েছেন সব কর্মকর্তা-কর্মচারী।

ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের মত হলো- সময়মতো পদোন্নতি হয় না, অনেকেরই দুয়েকটি পদোন্নতি নিয়ে চাকরি শেষ হয়। আবার অনেক বিভাগে সবার পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বহাল না থাকলে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। পে কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল সুবিধা বিলুপ্ত করা হলে কতো সংখ্যক জনবল আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তার একটি পরিসংখ্যান বের করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে বেশি জনবলের প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্মরতদের নিয়ে হিসেব করা হয়েছে। এই মন্ত্রণালয়গুলোর সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল সুবিধাভোগীর সংখ্যা মোট জনবলের ৬৫ দশমিক ৪১ শতাংশ।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, হঠাৎ করে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করা ঠিক হবে না। এতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হবে, যা কাজের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। বেতন দিগুণ বাড়লেও সরকারি চাকরিজীবীদের খুশি অনেকটা মলিন হয়ে যাবে। তিনি বলেন, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড চালু করার সময় অনেক চিন্তা-ভাবনা করেই করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব হয় না, দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে নিচের বেশিরভাগ পদেই পদোন্নতি নেই। পদোন্নতি দিতে না পারলেও সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল দিয়ে চাকরিজীবীদের সন্তুষ্ট রাখা হয়, যেটা জীবনযাপনের মান ঠিকরাখার ক্ষেত্রেও দরকার। তাই সিলেকশন গ্রেড বাতিল করলে অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

অর্থমন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মোট জনবল দুই লাখ তিন হাজার ৩১ জন, যা মোট জনবলের নয় দশমিক ৬৬ শতাংশ। তার মধ্যে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা দশ হাজার ৩৩ জন। এ মন্ত্রণালয়ে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কর্মরত তৃতীয় শ্রেণির জনবল এক লাখ ৬২ হাজার ৬৫৩ জন, যারা চাকরিতে প্রবেশের পর অধিকাংশই দীর্ঘদিন একই পদে কর্মরত থাকেন। আবার অনেককেই চাকরি জীবনে একই পদে কর্মরত থাকতে হয়। এছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণির নয় হাজার ৪৪৭ জনেরও পদোন্নতির সুযোগ কম। চতুর্থ শ্রেণির ২১ হাজার ১৯৮ জনের কোনো পদোন্নতি নেই। সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল হলে এই মন্ত্রণালয়ের ৯৫ শতাংশ জনবল আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় : এ মন্ত্রণালয়ের জনবল পাঁচ লাখ ৩২ হাজার ১৭০ জন। তার মধ্যে প্রথম শ্রেণির ১৩ হাজার ১৪৩ জন, দ্বিতীয় শ্রেণির ৩১ হজার ১৮৭ জন, তৃতীয় শ্রেণির ৪ লাখ ৫৭ হাজার ৫৮৫ জন। মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির জনবল পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি, বিজিবি, কারাগার ও ফায়ার সার্ভিসে কাজ করেন। এদের অধিকাংশই চাকরিতে প্রবেশের পর দীর্ঘদিন একই পদে এবং অনেকেই পুরো চাকরিকাল একই পদে কর্মরত থাকেন। সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করলে এ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত জনবলের মধ্যে ৯৪ শতাংশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, যা সরকারের মোট জনবলের ২৪ শতাংশ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় : এ মন্ত্রণালয়ের জনবল তিন লাখ ৪০ হাজার ১৯৭ জন। তার মধ্যে প্রথম শ্রেণির এক হাজার ৫২৯ জন, দ্বিতীয় শ্রেণির ৩৩ হাজার ৭৩৩ জন, তৃতীয় শ্রেণির ৩ লাখ ৩ হাজার ৯৫ জন, চতুর্থ শ্রেণির এক হাজার ৮৪০ জন। মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় শ্রেণির জনবলের প্রায় সবাই সহকারী শিক্ষক। এসব শিক্ষক চাকরি জীবনে কোনো পদোন্নতি পান না। সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল সুবিধা বাতিল করা হলে মোট জনবলের মধ্যে প্রায় ১৬ শতাংশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় : এ মন্ত্রণালয়ের জনবল পাঁচ লাখ ৬২ হাজার ২১০ জন। তার মধ্যে প্রথম শ্রেণির চার লাখ ৩৬ জন, দ্বিতীয় শ্রেণির ২২ হাজার ২৮১ জন, তৃতীয় শ্রেণির ৬০ হাজার ৭৭ জন, চতুর্থ শ্রেণির ৭৯ হাজার ৮১৬ জন। মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির জনবলের অধিকাংশই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিগত দিনে এসব শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত থাকলেও বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দেওয়া হয়। এ শিক্ষকরাও চাকরি জীবনে পদোন্নতি পাবেন না। ফলে এরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় : এ মন্ত্রণালয়ের জনবল এক লাখ ৬১ হাজার ১৫২ জন। তার মধ্যে প্রথম শ্রেণির ২১ হাজার ৫১৯ জন, দ্বিতীয় শ্রেণির ১৫ হজার ৬১৮ জন, তৃতীয় শ্রেণির ৯১ হাজার ৪৫১ জন, চতুর্থ শ্রেণির ৩২ হাজার ৫৬৪ জন। মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় শ্রেণির জনবলের অধিকাংশই স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারী। তারা কখনো পদোন্নতি পান না।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় : এ মন্ত্রণালয়ের মোট জনবল ২৫ হাজার ৩১০ জন। তার মধ্যে প্রথম শ্রেণির এক হাজার ৭১৩ জন, দ্বিতীয় শ্রেণির ২২৫ জন, তৃতীয় শ্রেণির ১২ হাজার ৬৩৪ জন, চতুর্থ শ্রেণির দশ হাজার ৭৩৮ জন। মন্ত্রণালয়ের চতুর্থ শ্রেণির অধিকাংশই ড্রাইভার। এদেরও কোনো পদোন্নতি নেই।

উল্লেখ্য, একই স্কেলে দীর্ঘদিন চাকরি করার পরও পদ না থাকায় পদোন্নতি হয় না। এ অবস্থায় নির্বাচিত কিছু সংখ্যক কর্মকর্তাকে শর্ত সাপেক্ষে উচ্চতর স্কেল দেওয়া হয়, যা সিলেকশন গ্রেড নামে পরিচিত। এ ক্ষেত্রে ৮, ১২ ও ১৫ বছরে গিয়ে সিলেকশন গ্রেড দেওয়া হয়। পদোন্নতি না পেলেও কর্মচারীরা আর্থিকভাবে লাভবান হন।

অন্যদিকে টাইম স্কেল হলো সরকারি চাকরিজীবী যখন ইনক্রিমেন্ট পেয়ে স্কেলের শেষ ধাপে পৌঁছে যান তখন পদোন্নতি দিয়ে পরের স্কেলে উন্নীত করার নিয়ম। কিন্তু পদোন্নতি না দিতে পারলে তখন টাইম স্কেল দিয়ে আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে টাইম স্কেল চালু হয়।

১৯৮৩ সালের নতুন নিয়ম অনুযায়ী ৮, ১৩, ১৬, ২০, ২৫ ও ২৮ বছর চাকরির পূর্তিতে বা বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছার এক বছর পর তৃতীয় স্কেল পর্যন্ত দুটি টাইম স্কেল দেওয়া হয়।


বিএ/এএ/আরআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।